অগ্নিঝরা মার্চ

7

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের গোড়ার দিকে একাত্তরের উত্তাল মার্চে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামও উত্তপ্ত হতে থাকে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের অংশ। হরতালের পাশাপাশি বিকেলে লালদীঘি ময়দানে সমাবেশেরও ঘোষণা দেয়া হয়। ন্যাপ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপসহ) বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন এই হরতালের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানায়।
একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ শেষে চট্টগ্রামে জননেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এম, আর, সিদ্দিকীর বাসায় সব গণ্যমান্য ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ এক সভায় যোগ দেন। সভার বিষয়বস্তু ছিল, চট্টগ্রামবাসীকে সংগঠিত করে আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ। বিকেলে চট্টগ্রাম রেস্ট হাউসের ২৩ নম্বর কক্ষে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় চট্টগ্রামে পাক আর্মির তৎপরতা ও আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আসন্ন যে কোন ধরনের পরিস্থিতির সামলানোর সব প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে এক সপ্তাহের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল, আগ্রাবাদ কলোনি স্কুল মাঠে ও আগ্রাবাদ জাতিতাত্বিক যাদুঘরের সামনে স্বেচ্চাসেবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এদিকে, সাহিত্যিক আবুল ফজলের বাসায় ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত হয় ‘শিল্প সাহিত্যিক প্রতিরোধ সংঘ।’
এদিকে, মার্চের প্রথম সপ্তাহের শুরু থেকে টানা হরতালে চট্টগ্রামে জনজীবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। হরতাল শেষে লালদীঘি ময়দানে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিরাজুল হক মিয়া। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়। এরপর নগরীতে সব পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে উত্তেজিত জনতা। পাকিস্তানি পতাকা অব্যাহতভাবে পোড়াতে থাকলে নগরীর বিহারী অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালি ও উর্দু ভাষী বিহারীদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে যায়। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের নামে প্রতিবাদী বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের হামলায় প্রায় একশ’ লোক নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হন। বিহারী কলোনি এলাকায় আবুল কালাম নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হলে লালদীঘি ময়দানে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে বিহারী-অধ্যুষিত ওয়ারলেস কলোনি, পাহাড়তলী ও আমবাগান একটি ভীতিকর এলাকায় পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), খেলাফতে রব্বানী ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ী সংগঠন নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের রক্ত দিতে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রতি আহব্বান জানায়। দাঙ্গা বন্ধে একটি সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে রাইফেল ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীকে সর্বদলীয় শান্তি কমিটির আহব্বায়ক করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দাঙ্গা বন্ধ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে নগরীর সর্বত্র শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই ধরনের উস্কানিমূলক ঘটনা যাতে জনগণের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে, সেজন্য এই শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নগরীর বিভিন্ন স্থানে গেরিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।