অগ্নিঝরা উত্তাল ঘটনাবহুল একাত্তরের মার্চ

9

জোনাকী দত্ত


বাংলাদেশ। এই নামটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পাওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ২ মার্চ ঢাকায় সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের ডাক, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। ৩ মার্চ বিভিন্ন স্থানে, মিছিলে গুলিবর্ষণ, ঢাকায় ২৩ জন নিহত, চট্টগ্রামে ৭৫ জন, ঢাকা, সিলেট ও রংপুরে কারফিউ জারি। ৪ মার্চ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে ১১৩ নং সামরিক আইন আদেশ জারি। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ১২১, খুলনায় নিহত ৬, ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার। ৫ মার্চ টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ, ৪ জন নিহত, ২৫ জন আহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮। রাজশাহী, রংপুরে আবার কারফিউ। ভুট্টোর সাথে ইয়াহিয়ার ৫ ঘন্টা বৈঠক। ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়ার ভাষণ, টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ। রাজশাহীতে মিছিলকারীদের উপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলি। ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত, সান্ধ্য আইন অব্যাহত। খুলনায় দাঙ্গা – হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণ। ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে সাড়ে তিনশ কয়েদির পলায়ন। গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দান। ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে ছাত্র নেতাদের একাত্মতা ঘোষণা। ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সকল সরকারি অফিস অচল। ১০ মার্চ বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের ২য় শ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমান বন্দরে চেক পোস্ট বসিয়ে অবাঙালিকে দেশ ত্যাগ করতে না দেয়ার হুমকি। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নিকট ভুট্টোর তারবার্তা। ঢাকায় আসতে রাজি আছেন বলে জানান। ৩২ হাজার টন গমভর্তি জাহাজ ভিনটেজ হরিজন ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা থাকলেও গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি অভিমুখে যাত্রা করেছে। ১২ মার্চ লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এক প্রতিবেদনে বলেছে শক্তি প্রয়োগ নিষ্ফল ও বিপজ্জনক হবে।
সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে মহিলা পরিষদের এক সভায় পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহŸান জানানো হয়। ১৩ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫ নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি। পশ্চিম জার্মানির ৬০ জন, জাতিসংঘের ৪৫ জন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের ৪০ জন সহ মোট ২৬৫ বিদেশিকে ঢাকা থেকে অপসারণ করা হয়েছে। ১৪ মার্চ দুই পাকিস্তানে দুই দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা ভুট্টোর। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন। সফরসূচিতে গোপনীয়তা। ১৬ মার্চ মুজিব – ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু। ১৭ মার্চ মুজিব – ইয়াহিয়া ২য় দফা বৈঠক সম্পন্ন। ১৮ মার্চ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন। আওয়ামী লীগের তদন্ত কমিটি বর্জন। ১৯ মার্চ মুজিব – ইয়াহিয়া ৩য় দফায় ৯০ মিনিটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ বলেন, মুজিবকে সমর্থন দেওয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। ২০ মার্চ মুজিব – ইয়াহিয়া ৪র্থ দফায় সোয়া দুই ঘণ্টার বৈঠক হয়। ২১ মার্চ ইয়াহিয়া মুজিবের ৭০ মিনিটের অনির্ধারিত বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমেদও ছিলেন। ২২ মার্চ ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব – ইয়াহিয়া বৈঠক। এদিকে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ডাক বঙ্গবন্ধুর।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত। ২৩ মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন। রাজধানীতে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪ মার্চ শেখ মুজিবের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের বৈঠক। কোন প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার খবর। এদিন সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রমনা কালী মন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী। ২৮ মার্চ বাঙালির প্রতিরোধের মুখোমুখি পাকিস্তান সেনারা। পুরান ঢাকায় জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন পরিত্যক্ত ভবনে বাঙালি শিক্ষক, হোটেল কর্মচারী, শিল্পীসহ ৮৮ জনকে হত্যা করা হয়। ২৯ মার্চ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ, যুদ্ধ। বাঙালি সেনাদের বিদ্রোহ। সন্ধ্যায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে তেজগাঁও বিমান বন্দরে এবং রাতে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। এই রাতে ঢাকায় একশর মতো বাঙালি ই পি আর সদস্যকে পাকিস্তানি সেনারা প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে ৩টি দলে ভাগ করে রমনা কালী বাড়ির কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এদিন রাত দেড়টার দিকে আইন সভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে কুমিল্লার বাসা থেকে পাক সেনারা নিয়ে যায়। তাদের আর কখনো পাওয়া যায় নি। মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অভিযানে ৪০ জন পাকিস্তান সৈন্য পাবনা থেকে গোপালপুরের পথে নিহত হয়। ৩০ মার্চ রংপুরে বর্বরতা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তারা শহর, গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায়। জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি। এদিন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিমান হামলা চালায় পাক বিমান বাহিনী। ৩১ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন ভারতের পার্লামেন্টে। পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে লক্ষাধিক শরণার্থী বিভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।
ঐদিন চট্টগ্রামের হালিশহরে নাথপাড়ায় পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়।সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিহারিরা এ হত্যাকাÐ চালায়। তারা অল্প সময়ের মধ্যে কুড়াল, কিরিচ ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ জন ইপিআর সহ ৭৯ জনকে হত্যা করে। ১ থেকে ৩১ মার্চ দিনগুলো ছিল অগ্নিঝরা দিন। অনেক ত্যাগ- তিতিক্ষা আর প্রাণের বিনিময়ে নয় মাস যুদ্ধ করে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করেন। এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঠিকভাবে জানানোর দায়িত্ব সচেতন নাগরিকের। আমি বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত একাত্তরের মার্চ মাসের ঘটনা প্রবাহ সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করেছি। সকল বীর, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্য সংগ্রহ: বাংলা ট্রিবিউন ঘোষণা গবেষণা বিভাগ।
দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ’৭১ এর দশমাস’, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ‘একাত্তরের দিনগুলি’।
লেখক : প্রাবন্ধিক