অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

160

জামাল উদ্দিন

বাঙালির ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম জীবন আত্মহুতি দেওয়া নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি জন্মেছিলেন ৫ মে ১৯১১ সালে পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে। এই জন্মদিবসে তাঁর প্রতি রইল অফুরান ভালবাসা। তাঁর ছোট বেলার নাম ‘রাণী’। পিতা : জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার, মাতা : প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। শিক্ষা জীবন শুরু ১৯২৪ সাল চট্টগ্রাম শহরের ডা. খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়ে। যথন তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তখন থেকেই বিপ্লবী মন্ত্রণালাভ করতে থাকেন। উক্ত বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে আই এ পাস করে মেয়েদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এইচ এসসি পাসের পর বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে ১৯২৯ সালে তিনি ভর্তি হলেন কলিকাতার বেতুন কলেজে। সেখানে ছাত্রী নিবাসে থাকা কালে কিছুদিনের মধ্যে যোগাযোগ হল বিপ্লবীদলের চট্টগ্রাম শাখার সদস্যদের সাথে। ওই বিপ্লবীদের মাধ্যমে মাষ্টারদা নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন প্রীতিলতার কাছে। সেই নির্দেশ মতো কলকাতায় গড়ে তুললেন এক বিপ্লবীচক্র। অল্প সময়ের মধ্যেই এই বিপ্লবী চক্রে অনেক মেয়ে এসে যোগ দিলেন।
কলকাতার এক গোপন কারখানায় বিপ্লবীদের আয়োজনে বোমার খোল তৈরী হয়, চট্টগ্রাম থেকে নির্দেশ আসে সে বোমার খোল সরবরাহ করার। পূজার ছুটিতে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলিনী পাল ও কুমুদিনী রক্ষিত অনেকগুলো বোমার খোল নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। বোমার খোলগুলো বিপ্লবীরা তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এই সূত্রেই বিপ্লবী অন্বিক চক্রবর্তী ও নির্মল সেনের সাথে তাঁদের পরিচয়। প্রীতিলতা চট্টগ্রাম থেকে পুনরায় চলে গেলেন কলকাতাস্থ বেতুন কলেজে।
বিপ্লবীদলের সৈনিক রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। তিনি ধরা পড়েন ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে। তাঁকে আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছোট বোন পরিচয়ে প্রীতিলতা কারাগারে একে একে চল্লিশবার দেখা করেছেন। ফলে তাঁর মধ্যে এক নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী এই দেশপ্রেমিকের সাহচর্য প্রীতিকে জীবনাদর্শকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তখন থেকে প্রীতিলতা মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হন। বিএ পরীক্ষা দেবে না- দেবে না ভেবেও পরীক্ষায় বসলেন তিনি। পরীক্ষা শেষও করলেন। ১৯৩১ সালে বিএ পাসও করলেন। তারপর চলে এলেন চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামে নতুন একটি মধ্য ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নন্দনকাননে। প্রীতিলতা ১৯৩১ সালে সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী পদে যোগদান করলেন। বর্তমানে ঐ বিদ্যালয়টি ‘অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ নামেই পরিচিত। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে তাঁকে কল্পনা দত্ত সংযোগ করে নিল মাষ্টারদার সাথে। তারপর বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাট গ্রামের গোপন ঘাঁটিতে সর্বাধিনায়ক মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে প্রীতলতার সাক্ষাত ঘটে ১৯৩২ সালের ১৩ জুন।
সাথী হল ভোলা, আসল নাম অপূর্ব। সে মাষ্টারদার একনিষ্ঠ ভক্ত কর্মী। শহর থেকে অপূর্ব-এর সাথে ছুটে চলেছেন গন্তব্যের দিকে। তাঁদের গন্থব্যস্থল সাবিত্রী দেবীর বাড়ি। ঐ বাড়িতে মাষ্টারদা আর নির্মলদা অপেক্ষা করবেন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় তাঁরা পৌঁছে গেলেন মাস্টারদার আস্থনায়। সাবিত্রী দেবীর দোতলা বাড়ি। মাটির দেয়াল। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করলে স্নেহলতা অভ্যর্থনা জানাল। মাষ্টারদা ও নির্র্মলদা ছাদে আছেন।
সাবিত্রী দেবী দরজার দিকে ফিরে বললেন, এসো। প্রীতিলতা চললেন তাঁর পিছনে। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে এসে বললেন, উপরে যাও। উপরে উঠতেই নেতাদ্বয় চোখ তুলে দেখলেন। প্রীতি প্রস্তরখোদিত মূর্তির মতো দন্ডায়মান। কথা বললেন মাষ্টারদা, এসো। দু’জনই বসেছেন ভেতরে পাটিতে। মাষ্টারদার পিঠ দেয়ালে হেলান দেয়া । মাষ্টারদা সোজা হয়ে বসে হাঁটু ভাজ করলেন। নির্মলদা পাটির শূন্য কোণে ইঙ্গিত করে বললেন, -বসো। প্রীতি ধীরে ধীরে পাটিতে হাঁটু পেতে হাত বাড়ালেন মাষ্টারদার পায়ের দিকে। মাষ্টারদার প্রতিরোধ -ভঙ্গীর হাত এল প্রীতির হাতের সামনে। মাষ্টারদার গম্ভীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যাদুময় শব্দ, প্রীতি এখন স্কুল -শিক্ষক নন, বিপ্লবী। বিপ্লবীদের প্রণাম করতেও নেই, নিতেও নেই, বিপ্লবীরা প্রণাম করে শুধু মা -মাটি-মাতৃভূমিকে। তুমিও বিপ্লবী, তুমিও এ নীতি মেনে চলবে। আমি যেমন এদেশের সন্তান, তুমিও। তুমি আমি পৃথক নই, একটি মাত্র পরিচয় ‘বিপ্লবী’, দেশমাতৃকার সেবক।
এ সময় সিঁড়িতে দ্রুত পদচারণার শব্দ। তাঁদের দৃষ্টি লাফিয়ে পড়ে সিঁড়ির মুখে। অপূর্ব লাফিয়ে আসে উপরে। উচ্চারণ করে একটি মাত্র শব্দ ‘পুলিশ’। মুহূর্তে লাফিয়ে ওঠেন মাষ্টারদা ও নির্মলদা। ভোজবাজীর ভেলকির মতোই রিভলবার এসে পড়ে ওঁদের হাতে। মাষ্টারদা প্রীতির উদ্দেশ্যে নির্দেশ বাক্য ছোড়েন -নিচে চলে যাও, ওদের আত্মীয় পরিচয় দিও। যাও -তাড়াতাড়ি। প্রীতি থাকতে চাইলেন। ‘না’ বলে গর্জন করলেন মাষ্টারদা। প্রীতি লাফ দিলেন সিঁড়ির দিকে। রিভলবার হাতে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল ক্যাপ্টেন ক্যামারণ। তার পিছনে পিছনে ঢুকল অনেক ব্রিটিশ সৈনিক।
ক্যামরণ দ্রুত উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। পৌঁছে গেছে মাঝামাঝি। নির্মলদা সিঁড়ির মাথায়। গুড়–ম্ …এক ঝলক আগুন বেরুল নির্মলদার রিভলবার থেকে। ক্যামারণও গুলী ছোড়ে। আবার উপরের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে অগ্নিবর্ষণ হয়, গুড়ুম গুড়–ম্ প্রচন্ড গোলাগুলীর শব্দে বাড়ি কাঁপতে থাকে। ক্যামারণ হঠাৎ ছিটকে পড়ে নিচে। একটু হাত পা নেড়ে স্তব্ধ হল ক্যামরুনের দেহ। গোলাগুলীর শব্দ থেমে গেল। মাঝ সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লেন মাষ্টারদা। অপূর্ব সেন তাঁর পাশে। রিভলবারের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে প্রীতিকে নির্দেশ দেন, অপূর্বের সাথে যাও।
প্রীতি ছুটলেন অপূর্বের সাথে। মাষ্টারদা লাফিয়ে চলে এলেন তাঁদের পাশে অন্ধকারে। হঠাৎ গুড়–ম্ শাব্দে প্রীতির পাশ থেকে অপূর্বের দেহটা পড়ে গেল। মাষ্টারদার হাতের টানে প্রীতি ছিটকে চলে গেলেন অনেক দূরে। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়ের ভিতর। পানাভরা গড়, জলভর্তি, প্রচন্ড ঠান্ডা। মাষ্টারদাও প্রীতির পাশে লাফিয়ে নেমেছেন। কিন্তু কোনশব্দ বা কথাবার্তা নেই। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসছে পুলিশ। শ্বাস নেয়ার জন্য নাক উপরে রেখেছে শুধু। মাথার উপরেও কচুরিপানার ডগা আর পাতা। তার উপরে ঘন অন্ধকার। দু’মিনিট পর আগুনের আলোয় আলোকিত হল চারিদিক। দাউ দাউ জ্বলছে আগুন, জ্বলছে সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি। ক্যামারণ -হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে সশস্ত্র ব্রিটিশ বাহিনী।
চারিদিক নিস্তব্ধ। পাশের পানা নড়ল। চাপা কণ্ঠ মাষ্টারদার, -ওপারে উঠব, এসো। পানা সরিয়ে চলে গলেন প্রীতি। মাষ্টারদা তাঁর হাত ধরে টেনে তুললেন উপরে। ছুটলেন তারপর দু’জনে। দূরে-ঠিকানাহীন।
ধলঘাট যুদ্ধের চল্লিশ ঘণ্টা পর অপর্ণাচরণ মধ্য ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার অফিসের চেয়ারে প্রীতিলতা উপবিষ্ট, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন প্রধান শিক্ষিকার। রূপকথার কাহিনীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে ধলঘাট যুদ্ধের খবর। পত্র-পত্রিকাতেও ঘটনার বিবরণ এক নয়। ঘটনাস্থলে মৃতদেহ দু’জনের। একজনের দেহ সনাক্ত হয়েছে, নাম নির্মল সেন। দ্বিতীয় জনের দেহ সনাক্ত হয়নি। সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। পুলিশ ওই বাড়িতে চারজন সন্ত্রাসীর সন্ধান পেয়েছিল। চারজনের একজন মেয়ে। দু’জন সন্ত্রাসীকে পুলিশ গুলী করে মারতে বাধ্য হয়েছে। মেয়েটিকে সাথে নিয়ে এক সন্ত্রাসী পালিয়ে যায়। ও দু’জনকে ধরার জন্য পুলিশ তল্লাসী চালাচ্ছে। ও দু’জনের সংবাদ দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।
১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কাট্টলীর ঘাঁটি থেকে মাষ্টারদার আহবান এল প্রীতিলতার কাছে। তিনি ছুটে গেলেন ঘাঁটিতে। দাঁড়ালেন তাঁর মুখোমুখি। তিনি দৃপ্ত উচ্চারণে বললেন- বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ আর কালারপুল, দেশপ্রেমিক তরুণ-প্রাণ দেশের জন্য আত্মবলিদান করেছে, তাদের রক্তে দেশের মাটিসিক্ত। আজ বাঙলার ঘরে ঘরে মায়েরা, বোনেরা, কন্যারাও মেতেছে স্বদেশপ্রেমের মহা-মরণ খেলায়। আমি চাই, ঝাঁসীর রাণী আর নাটোরের রাণীর মতোই ইতিহাস। শঠ, প্রবঞ্চক, নিপীড়ক ব্রিটিশ জানুক, জানুক বিশ্বজগত, আমার বাঙলার মেয়েরা ও মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সৈনিক।
মাষ্টারদার কণ্ঠ থামল একটুখানি। তিনি পায়চারি করলেন দু’সেকেন্ড। দাঁড়িয়ে চোখ তুললেন প্রীতির চোখের দিকে। বললেন, ২৩ শে সেপ্টম্বর, ১৯৩২, পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে। তার নেতৃত্বে থাকবে তুমি, চট্টগ্রামের রাণী, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এই অমোঘ নির্দেশ ঘোষণা করে মাষ্টারদা স্থানান্তরে চলে গেলেন। প্রীতি পাষাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন অনেক্ষণ। প্রীতির সমগ্র সত্তায় প্রতিধ্বনি হচ্ছে একটি বাক্যের, চট্টলার রাণী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার’।
প্রীতি তৈরী হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। সাগরের বেলাভূমিতে চলছে তাঁর অস্ত্রচালনা- শিক্ষা। দু’দিনেই অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত। মাষ্টারদা রায় দিলেন, -এই যুদ্ধের যোগ্য সেনাপতি প্রীতি। প্রীতিলতা দেশপ্রীতির মহিমায় সমুজ্জ্বল নয় শুধু, বিদ্রোহের অনলে পুড়ে খাঁটি সৈনিক। বিদ্রোহানলকে হাতের কজ্বিতে পুঞ্জীভূত করে অস্ত্রের ট্রিগার চেপে কিভাবে অনল বর্ষণ করতে হয় তা সে জেনে গেছে। যাত্রার পূর্বে মাষ্টারদা সাথীদের সঙ্গে প্রীতির পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রীতির পুরুষ-বেশ নিরীক্ষণ করলেন। তিনি কঠিন চোখে প্রীতির সাথী বিপ্লবীদের পোশাকও দেখলেন। তারপর উচ্চারণ করলেন, শান্তি চক্রবতী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী, এই পাঁচজন তোমার সহযোদ্ধা। প্রীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, এ হচ্ছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আজকের যুদ্ধের সেনাপতি।
কারো মুখে কোন কথা নেই, নেই শ্বাস ফেলার শব্দও। সবাই স্ট্যাচুর মতো দÐায়মান, মরণযুদ্ধের সংকল্প দৃঢ়। মাষ্টারদার কণ্ঠ ধ্বনিত হল আবার,-ক্লাবের পশ্চিম দিকে। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটা যখন হবে একটা টর্চের আলো পড়বে তোমাদের দিকে। সে আলোর সংকেত দেখাবে ক্লাবের বাবুর্চি মনসুরুল করিম। সেও মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক। আলোর সংকেত পেলেই তোমরা ছুটে যাবে। ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক থেকে আক্রমণ চালাবে। তোমরা সফল হও। নির্দেশ দিয়ে মাষ্টারদা সাগরতীরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
প্রীতির নেতৃত্বে বিপ্লবীরা পায়ে হেঁটে পৌছলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। অপেক্ষা করছেন ক্লাবের বাবুচি মনসুরের কাছ থেকে আলোর সংকেতের জন্য । আলোর সংকেত পাওয়া গেল। প্রীতিলতা ‘চার্জ’ নির্দেশ ঘোষণা করলেন। বিপ্লবীরা লাফ দিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেলেন শত্রুর খুব কাছে। গুলীবর্ষণ, বোমা নিক্ষেপ দ্রুত চলছে। উন্মত্ত বল নাচ থমকে দিয়ে জেগে ওঠে মরণ চীৎকার। সে চীৎকারও স্তব্ধ করে দিলেন বোমা আর বুলেটের ঘা মেরে। সফল আক্রমণ শেষে প্রীতি হুইসেল বাজিয়ে সহযোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তন নির্দেশ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধ শেষ, বিপ্লব সফল। সাথীরা মার্চ করছে। প্রীতিলতা পেছনে। ঘাঁটিতে পৌঁছতে সময় খুব লাগবে না তাঁদের। জয়ের আনন্দ সবার মধ্যে। হঠাৎ পাশ থেকে একটা গুলি ছুটে এল, বিদ্ধ হল প্রীতির বুকের ডান দিকে। প্রীতিলতা বুকে হাত চেপে দৌঁড়তে চেষ্টা করলেন। পারলেন না, রাস্তার ধূলোয় পড়ে গেলেন। প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে প্রীতির, যন্ত্রণার ঝড় উঠতে চাইছে তাঁর দেহজুড়ে । নির্মলদা অবাক হয়ে দেখছেন তাঁকে। সংজ্ঞা ফিরে আসে প্রীতির। ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে জন্ম নয় তাঁর। তিনি বিপ্লবী কন্যা-অগ্নিকন্যা ! বীর প্রসবিনী চট্টলার মহাবীর ব্রিটিশত্রাস মহানায়ক সূর্য সেনের ভগিনী প্রীতিলতা! জীবন্ত দেহ কাকেও স্পর্শ করতে দেবে না। ইংরেজের শক্তি নেই কারাগারে বন্দী করা। চিরমুক্তির পাথেয় প্রীতির কাছে গচ্ছিত। গচ্ছিত পটাসিয়াম সায়েনাইট। হ্যাঁ, পকেটেই আছে। পুলিশ-মিলিটারী-গোয়েন্দা খুব সাবধানে এগিয়ে আসছে প্রীতির দিকে। তাদের হাতের রাইফেলের মুখে সুতীক্ষ্ন বেয়নেট। সে বেয়নেট বাগিয়ে আসছে ওরা। একটি শক্তিশালী টর্চের আলোয় আলোকিত প্রীতির চারিদিকে। প্রীতির মুখে হাসির ঝলকানি। প্রীতি হাসতে হাসতে উচ্চারণ করলেন, জননী জন্মভূমি! আমার বন্ধন-মুক্তির দিন এগিয়ে আসছে। তখন ঘড়ির কাটা ২৩ শে সেপ্টম্বর মধ্যরাত পেরিয়ে ২৪ সেপ্টম্বর ১৯৩২। পটাসিয়াম সায়েনাইট অর্থাৎ মৃত্যু হাতে ধরা ছিল, মুখে ফেলে দিলেন। ভূমি-মা অনন্ত বাহুর বন্ধনে তিনি জড়িয়ে নেন। ঘুমালেন তিনি আমার মা-মাটির কোলে।
লেখক: গবেষক, লেখক ও প্রকাশক