অখন্ড ভারতবর্ষের কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু

36

রতন কুমার তুরী

সুভাষচন্দ্র বসু। অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনবদ্য সাহসী নেতা। যিনি তার নেতৃত্বগুণের জন্য নেতাজী উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতবর্ষসহ পুরো এশিয়ায় নেতাজী নামেই সমধিক পরিচিত। এই মহাননেতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন তৎকালীন অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ সুভাষ ছাত্রাবস্থা থেকেই একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। ১৯৪৪ সালের একসভায় তৎকালীন বার্মাতে এক র‌্যালিতে তিনি এই উক্তি করেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তিটি হল ‘ভারতের জয়’ অর্থাৎ হিন্দিতে যাকে বলা হয় ‘জয় হিন্দ’ যা পরবর্তীকালে ভারতবাসীদের জন্য একটি শক্তিশালী শ্লোগানে পরিণত হয় এবং পরবর্তী সরকারগুলো এটি গ্রহণ করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করেন। ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপানীদের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত দিনমজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
তৎকালীন সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি যখন ভারতের ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করেছিলেন ঠিক তখন ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একমাত্র সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন এতে জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুব নেতারা তাকে সমর্থন করেন। সুভাষ চন্দ্রের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণেই শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংহের ফাঁসির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে সুভাষ কারারুদ্ধ হয়ে দেশান্তরি হয়েছিলেন পরবর্তীতে সব বাধা উপেক্ষা করে ভারতবর্ষের মাটিতে ফিরে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রথম জীবন: সুভাষচন্দ্র বসু ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কটক-প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালি আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চোদ্দো সন্তানের মধ্যে নবম সন্তান। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র একটি কটকের ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন, বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টিওয়ার্ট স্কুল। এরপর তিনি কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া’। এই সময় অমৃতসর হত্যাকাÐ ও ১৯১৯ সালের দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র স্বরাজ নামক সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। বাংলায় উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। ১৯২৪ সালে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। এখানে তিনি য²ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কর্মজীবন ও রাজনীতিতে প্রবেশ: প্রায় বিশ বছরের মধ্যে সুভাষ চন্দ্রকে মোট ১১ বার গ্রেফতার করা হয়েছিলেন এবং তাঁকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে তাঁকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি ভিয়েনায়তে এমিলি সেচঙ্কল এর সাথে পরিচিত হন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে কিচ্ছুক্ষণের জন্য কলকাতায় আসার অনুমতি দেয়। ১৯৩৮ সালে তিনি গান্ধীর বিরোধিতার মুখে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরি অধিবেশনে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে গান্ধী পট্টভি সিতারামায়াকে সমর্থন দেন, নির্বাচনের ফলাফল শোনার পর গান্ধী বলেন ‘পট্টভির হার আমার হার’। সুভাষ চন্দ্র বসু এ নির্বাচনে জয় লাভ করলেও গান্ধীর বিরোধীতার ফল স্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে নইলে কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্য পদত্যাগ করবেন। এ কারণে তিনি নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সুভাষচন্দ্র বসুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারত রক্ষা আইনে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুকে মারাত্মক বিপ্লবীরূপে পরিগণিত করে গ্রেফতার করে প্রথমে ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে’ কারারুদ্ধ করে রাখে ও পরে অসুস্থতার কারণে কলকাতার এলগিন রোডে নিজের বাসভবনেই তাঁকে কড়া পুলিশ পাহারায় নজরবন্দি করে রাখে। তিনি বুঝতে পারলেন ব্রিটিশরা তাঁকে যুদ্ধের আগে ছাড়বে না। তাই তিনি দুইটি মামলার রায় বাকি থাকতেই আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানী পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ১৯ শে জানুয়ারি পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে তিনি একটি গাড়িতে করে পালিয়ে প্রথমে মথুরাতে যান। তারপর ‘গিয়াসউদ্দিন’ ছদ্মনামে কাবুলে যান। সেখান থেকে মস্কোতে যান এবং স্ট্যালিনের কাছে অসহযোগিতার ধারণা পেয়ে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ২৮ শে মার্চ জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এসে উপনীত হন। বার্লিনে প্রবাসী ভারতীয়গণ তাঁকে নেতাজি আখ্যা দেন এবং জয়হিন্দ ধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেন। এখানে এসে নেতাজি হিটলারের বিদেশমন্ত্রী রিবেন ট্রপের সঙ্গে দেখা করেন। ইটালির মুসোলিনীর সঙ্গেও তিনি দেখা করেন। পরে জার্মান সরকারের সহায়তায় জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে তিনি ভারতীয় মুক্তিবাহিনী গঠনের চেষ্টা করেন। এ সময় বার্লিন বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি নিয়মিত ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার আহবান জানাতেন। প্রকৃতপক্ষে সুভাষ চন্দ্র বসু স্বশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমের মাধ্যমে ভারতকে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতকে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিললন বলে তিনি তাদের রোষানলে পড়েছিলেন আর তাই ইংরেজরা তাকে বারবার গ্রেফতার করে বিভিন্ন জায়গায় রেখেছিলেন।
অবশেষে সুভাষ যখন বুঝতে পারলেন যে ভারতবর্ষে থেকে কখনও ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা এনে দেয়া সম্ভব নয় আর তাই তিনি রাতের আঁধারে ভারত থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন দেশের জনমত গঠন করতে এবং তিনি সেই কাজটি করেছিলেনও সুচারুভাবে। তখন তিনি জার্মান, জাপানসহ প্রায় ১১টি দেশের সমর্থন আদায় করেছিলেন এবং জার্মানি থেকেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই অসম সাহসী বিপ্লবী বীর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন ছিল গত ২৩ জানুয়ারি। অখÐ ভারতবর্ষের এই বিপ্লবীর বীর নেতার প্রতি রইলো আমাদের সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক