১৫ আগস্ট বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ক্রীড়াঙ্গনে বঙ্গবন্ধু পরিবার

3

মোহাম্মদ সরওয়ার আলম চৌধুরী মনি

১৫ আগস্ট প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন। বাঙালি হারায় তাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এদিন বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। ঘাতকের বুলেট বিদ্ধ করে কালজয়ী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে- সপরিবারে। বিদ্ধ হয় গোটা বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশ। রচিত হয় পৃথিবীর এ যাবতকালের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্যতম ইতিহাস। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতক চক্রের হাতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তিনি ছিলেন পরাধীন বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বিশ্বের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা, বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালির প্রেরণার চিরন্তন উৎস ও অবিসংবাদিত নেতা।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাÐের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সকল অনুভূতি, ত্যাগ, সংগ্রাম, বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব, অদম্য স্পৃহা, দৃঢ় প্রত্যয়, বাঙালি জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও আদর্শের দ্বারা সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত আত্মত্যাগে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স্রষ্টা, বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালি জাতির পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। উন্নত সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নসারথি।
বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব- তাঁর চেতনা অবিনশ্বর। বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবাদর্শে শাণিত বাংলার আকাশ-বাতাস জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবাহমান থাকবে।
রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট। বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য, শোষণ- বঞ্চনা মুক্ত করার জন্য যিনি রাজনীতি বেছে নিয়েছেন, সেই মহৎ মানুষটি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের রয়েছে ক্রীড়াঙ্গনেও বর্ণাঢ্য পদচারণা। বঙ্গবন্ধুর পরিবার এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের বাতিঘর। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন পরিচিত ফুটবলার। পেশাগত জীবনে সেরেস্তাদার হলেও খেলাধুলার প্রতি ছিল বিশেষ অনুরাগ। তিনি গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব ফুটবল টিমের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পিতার পথ ধরে বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবনে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অধিনায়ক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফুটবল, হকি ও ভলিবল খেলতেন। চল্লিশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের যখন রমরমা অবস্থা, তখন বঙ্গবন্ধু এই ক্লাবের হয়েই স্ট্রাইকার পজিশনে মাঠ মাতিয়েছেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ফুটবল খেলেছেন ওয়ান্ডার্সের হয়ে। অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। তার নেতৃত্বেই তখন ওয়ান্ডার্স ক্লাব বগুড়ায় অনুষ্ঠিত একটি গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় করে। তিনি ধানমন্ডি ক্লাবেরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ফুটবলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগের কারণেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠিত হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ভূমিকা আজও স্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ফুটবল ম্যাচ হয় ১৯৭২ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় স্বাধীনতাকামী ফুটবলারদের নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে এদিন একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হয়। খেলায় মুজিবনগর একাদশ ও প্রেসিডেন্ট একাদশ অংশ নেয়। ম্যাচটি স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে সরাসরি তৎকালিন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপভোগ করেন। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে কলকাতার মোহনবাগান দল এবং ১৯৭৩ সালে রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাব ঢাকা খেলতে এলেও খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
ক্রীড়া অনুরাগী ছিলেন বিধায় বঙ্গবন্ধু নিজে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম তদারকি করতেন। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ‘৭২ সালে তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড গঠিত হয়। এটির বর্তমান রূপ ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড’। একই বছর বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার বর্তমান নাম ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ’। এটি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাধীন ৫৩টি ভিন্ন ভিন্ন খেলাধুলা বিষয়ক সংস্থাকে। ১৯৭৪ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ স্পোটর্স কাউন্সিল অ্যাক্ট’ পাস করেন। ১৯৭৫ সনের ৬ আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। উদ্দেশ্য ক্রীড়া, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার ক্ষেত্রে যার বিশেষ অবদান রেখেছেন বা রাখছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের কল্যাণ।
বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন খেলাধুলা পছন্দ করতেন, তেমনি সবাইকে খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ যোগাতেন। আজকের যে কলাবাগান মাঠ, স্বাধীনতার পূর্বে সেটা ছিলো সিএন্ডবি’র ডিপো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ডিপো সরিয়ে নেয়ার পর তার আর্থিক অনুদান এবং অনুপ্রেরণায় কলাবাগান মাঠ সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে শেখ কামাল ও শেখ জামাল মাঝে মাঝে এই মাঠে ফুটবল খেলতে আসতেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু নিজেই মাঠে নেমে পড়েছিলেন ফুটবল খেলার জন্য।
একটি পরিবারের বাবা যদি ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়ানুরাগী হন, তাহলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সে পথেই হাঁটবেন, এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথই অনুসরণ করে গেছেন তাঁর দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল। এই দু’ভাইয়ের মধ্যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন শেখ কামাল। তিনি ফুটবল, ক্রিকেট ও বাস্কেটবল তিনটি খেলাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন। তবে ফুটবলে আনুষ্ঠানিকভাবে লিগে না খেললেও আবাহনীর হয়ে তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। আর বাস্কেটবল খেলেছেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে। তার অধিনায়কত্বে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বাস্কেটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। মহসীন স্মৃতি ট্রফিও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স জয় করে তারই অধিনায়কত্বে। আজকের আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল। ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্রিকেট লীগে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও একই বছর বাস্কেটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলের খেলোয়াড় ছিলেন শেখ কামাল। সেবছর সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন দ্রæততম মানব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাডমিন্টন দ্বৈতে রানার্সআপ হয়েছিলেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল খেলোয়াড় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও ছিলেন খেলোয়াড়। ফুটবল-ক্রিকেটের প্রতি ছিল বিশেষ ঝোঁক। তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ঢাকা লীগে খেলেছিলেন। শেখ জামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রে ক্রিকেটও খেলতেন।
শেখ কামালের পাশাপাশি শেখ জামালও ভালোমানের হকি খেলোয়াড় ছিলেন। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকি (শেখ কামালের স্ত্রী) ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অ্যাথলেটদের একজন। ১৯৬৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের লংজাম্পে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জিতে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লংজাম্পে নতুন রেকর্ড গড়েন খুকি। ২ বছর পর অল পাকিস্তান মহিলা অ্যাথলেটিক্সে লংজাম্পে খুকি নতুন রেকর্ড গড়েন। মেয়েদের মধ্যে সেরা হন তিনি। ১৯৭৩ সালে ১০০ মিটার হার্ডলসেও প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও হার্ডলসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সুলতানা কামাল খুকি নিখিল ভারতে গ্রামীণ ক্রীড়ায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ‘জয়বাংলা’ বলে লংজাম্প দিয়ে খুকি সেবার দ্বিতীয় হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের মধ্যে বেঁচে থাকা দু’মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাও দারুণ রকম ক্রীড়ানুরাগী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো সব সময়ই দেশের খেলাধুলার খোঁজ রাখেন। তিনি ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে আপনজন, দায়িত্বশীল অভিভাবক, নিবেদিতপ্রাণ দর্শক, ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি এতোটাই ক্রীড়াপ্রেমী যে যেখানে খেলা, শত ব্যস্ততার মাঝেও সেখানেই ছুটে যান শেখ হাসিনা। উৎসাহ যোগান লাল-সবুজ ক্রীড়াবিদদের। ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনাকালেই ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের বড় অর্জনগুলো এসেছে।

লেখক : কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা