হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ, সামনে কী?

4

আকতার কামাল চৌধুরী

হামাসের চৌকস আক্রমণে দিশেহারা ইসরায়েল এখন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের স্টিয়ারিং এখন তাদেরই হাতে। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতবিহ্বল ইসরায়েল এখন যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও দূর্বিণীত, আরও ক্ষিপ্র, আরও বেপরোয়া। কেউ তাদের থামাতে পারছে না। পুরো মুসলিম বিশ্ব হাসছিল একসময়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় হামাসের বিরত্বগাঁথার রগরগে খবর চাউর হয়েছিল চারদিকে। ভাবখানা এমন, যেন আরেকবার মক্কা বিজয় করে ফেলেছে মুসলিম জাতি। ‘জেরুজালেমের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’ -এমন না না মুখরোচক ভিডিওতে ছেয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আর এখন? এখন কল্পনার বেলুন চুপসে গেছে। আবেগ নিঃশেষ। সম্মুখ যুদ্ধে টেকা দূরে থাক, প্রাণ বাঁচানোই দায় হয়ে উঠেছে হামাস ও গাজাবাসীর। এই বাস্তবতা এতটাই কঠিন যে, হামাস না পারছে সামনে এগুতে, না পারছে পিছু হঠতে। তাদের হাতে বন্দী ২৫০ জনের মতো ইসরায়েলীই এখন তুরুপের তাস, ইসরায়েলের সাথে দর কষাকষির ‘অমূল্য সম্পদ’! কিন্তু আটক ইসরায়েলীরাই যে প্যালেস্টাইন দখলদারত্বের জন্য দায়ী -তা তো নয়।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ইসরায়েলী বাহিনী পুরো গাজা ঘিরে ফেলেছে। বেনামিন নেতানিয়াহু ইতোমধ্যে ঘোষণাই দিয়ে রেখেছেন, পুরো গাজার কর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকবে। অর্থাৎ গাজা এখন তাদেরই দখলে। এই কর্তৃত্ব পেতে তারা স্মরণকালের ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার প্যালেস্টাইনীকে হত্যার পাশাপাশি পঙ্গু বানিয়ে দিচ্ছে অগুনতি মানুষকে। চারদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা। খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই, তেল নেই, কবর দেওয়ার যায়গা নেই, শুয়ে-বসে থাকারও যায়গা নেই। চারদিকে শুধুই নেই আর নেই। ইতোমধ্যে কয়েকটি হাসপাতালেও বিমান হামলা চালিয়ে বহু নার্স, ডাক্তার এমনকি বোমায় ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষজনকেও হত্যা করেছে। শরনার্থী শিবিরও বাদ যাচ্ছে না বোমা হামলা থেকে। জাতিসংঘের মহাসচিব ঠিকই বলেছেন, ‘ইসরায়েলী বাহিনী পুরো গাজাকে শিশুদের সমাধীক্ষেত্র (কবরস্থান) বানিয়েছে’। লাখ লাখ প্যালেস্টাইনী জীবন বাঁচাতে কোলের শিশুসন্তান, বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে ছুটছে দিক্বিদিক, যেদিকে দুচোখ যায়। এ এক অনিশ্চিত যাত্রা প্যালেস্টাইনীদের।তারা জানে না নিজেদের বসতবাড়িতে আদৌ ফিরে আসতে পারবে কি না। কারণ, তারা জানে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির মদদে আরবের যে ভূখন্ড ইসরায়েল একবার দখল করেছে সেটাই তাদের ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, শত চেষ্টায়ও তা আর ফেরত নেওয়া যায়নি। সেই একই পরিক্রমায় এবারও হয়তো ভূমি হারানোর আরেকটা উপাখ্যান লেখা হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।
একদিন হয়তো যুদ্ধ থেমে যাবে। ততদিনে হামাস তথা প্যালেস্টাইনীদের উপর ইসরায়েলের প্রতিশোধ নেওয়াও শেষ হবে, রক্তের পিপাসাও মিঠেযাবে। ইসরায়েলী সেনাদেরও একসময় পানসে লাগবে এই অভিযান। তাদেরও মনে হবে -‘একতরফা আর কতো! অনেক হয়েছে,এবার ক্ষান্ত দিই। হাজার দেড়েক ইসরায়েলীর মৃত্যুর জন্য আর কতো প্রাণ নেবো! হিসেবের খাতায় এই অনুপাতটা বড়োই বেমানান, একের বিপরীতে এক হাজার’। ততদিনে ইউপ্রেটিস নদী দিয়ে বহু জলরাশি গড়িয়ে যাবে। গাজায় ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হাতেগোনা যে কয়েকটি দালান দাঁড়িয়ে থাকবে। ইসরায়েল ও-গুলোকে সামরিক ঘাঁটি বানাবে। গাজার প্রবেশমুখে সামরিক চৌকি বসবে। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায়য় দেশ-বিদেশের বহু মানুষ ওখানে বসবাস করা শুররু করবে। বেদখল হয়ে যাবে প্যালেস্টাইনীদের বসতভিটা, বহু ধনসম্পদ।
এদিকে বাস্তুচ্যুত হওয়া ১৫ লাখেরও বেশি প্যালেস্টাইনী গাজায় তাদের বাড়িঘরে ফিরতে অস্থির হয়ে উঠবে। কিন্তু ফেরা অত সহজ নয়। ইসরায়েলী বাহিনী ‘সন্ত্রাসী হামাস’ তকমা লাগিয়ে তাদের গাজায় ঢুকতে বাধা দেবে। অনেক দেনদরবার করে ইসরায়েলী বাহিনীর কাছে দাসখত দিয়ে অনেকে নিজ বাড়িঘরে আসার অনুমতি পাবে বটে, কিন্তু এসে দেখবে, গাজা সিটি এখন বিরানভূমি, নিজের বাড়িঘর পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে তাদের। ইসরায়েল এই কড়াকড়ি একসময় শিথিল করবে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে, মুখরক্ষা তাগিদে। তখন বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী দলে দলে গাজায় প্রবেশ করবে। ততোদিনে হামাস যোদ্ধাদের অনেকেই নিহত, আর যারা বেঁচে থাকবে তারা আত্মগোপনে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে গেরিলা হামলা চালানোর চেষ্টায় রত থাকবে। যারা ফিরে আসবে তাদের অনেকেরই যুদ্ধে প্রিয়জন হারিয়ে গেছে। অনেকের কেউ-ই আর বেঁচে নেই, আবার অনেকেই চিরপঙ্গু।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, তারা গাজা দখল করবে না, শাসনও করবে না। আরব রাষ্ট্রগুলোর চাপে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নেতানিয়াহুকে এটা বলতে বাধ্য করেছেন নিশ্চয়। যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল গাজা দখল বা শাসন করবে না বটে কিন্তু নিজের কব্জায় রেখে দেবে। শুরু হবে প্যালেস্টাইনীদের নতুন ঘরনার আন্দোলন, গাজার সার্বভৌমেত্বের আন্দোলন, ইসরায়েলী সেনা প্রত্যাহারের আন্দোলন এ-ই যখন গাজার ভবিষ্যৎ, তবে হামাস কী ভেবে, কোন খুঁটির জোরে এই হামলা চালিয়েছিল তা আমার মাথায় আসে না। তাদেরও তো একটা রণকৌশল ছিল। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি সম্পর্কেও তাদের ধারণা না থাকার কথা নয়। অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দেওয়া স্যাটেলাইট সুবিধা, রাডার ফাঁকি দেওয়ার মতো মিসাইল ও যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক বোমা সর্বোপরি মোসাদের মতো শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী যাদের করতলে- তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে দশ বার ভাববে কোনো দেশ। এই শক্তিমত্তা সম্পর্কে নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল হামাস। শেষমেশ কী দেখলাম! হামাসের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধবিরতি ‘ভিক্ষা’ করছে। তাদের হাতে আটক ৭০ জন বন্দীর বিনিময়ে অন্তত ৫ দিনের যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। কিন্তু পাঁচ দিন পর কী হবে? কোন অলৌকিক শক্তি কাজে লাগাবে পাঁচ দিন পর? বলতেই হবে, এটা হামাসের পশ্চাদপসরণ, অদম্য মনোবল ভেঙে যাওয়ার ল²ন, মনস্তাত্তিক পরাজয় এবং অনেকটা আত্মসমর্পণও।
এদিকে অস্ত্রশস্ত্র ও নানাবিধ প্রযুক্তি দিয়ে সরাসরি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের পশ্চিমা মিত্ররা। এই মিত্ররা ইসরায়েলের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতেও পিছিয়ে নেই। ইতোমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু হামাসের বেলায় এমন কোন দেশ আছে,যারা তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ভূমিকা রাখবে? না, কেউ নাই এবং কেউ নাই। ইরান হয়তো উচ্চকণ্ঠ, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের চিরবৈরীতার কারণে। হামাসের জন্য সরাসরি কিছু করার সাহস ও সুযোগ কোনোটাই নেই ইরানের। আরব লীগের আহবানকে পাত্তাই দেয়নি ইসরায়েল। ওআইসির বৈঠকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মতৈক্য পৌঁছাতে পারেনি আরব রাষ্ট্রগুলো। কোনো না কোনোভাবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিম্মি, অনেকের ক্ষমতার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে হোয়াইট হাউসের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ারে। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলে এমন সাধ্য কার! এ-ই যখন বাস্তবতা, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দুনিয়া তোলপাড় করা একদিনের চোখধাঁধানো আক্রমণে মুসলিম জাতির মস্তিষ্কে গোলকধাঁধা বাঁধিয়ে দেওয়ার যুক্তিটা কী? এতো মৃত্যু, এতো সম্পদ ধ্বংসের দায় কে নেবে আজ? এই আক্রমণ কি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করবে?
জানি, প্যালেস্টাইনীদের কষ্ট পাহাড় সমান। সেটা জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তনি গুতেরেসের বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘প্যালেস্টাইনীরা ৫৬ টা বছর শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হচ্ছেন। ফলে হামাসের হামলা খালি খালি ঘটেনি’। কিন্তু নীতিকথা কোনো কাজে আসেনি। শুধু হামাস নয়, পুরো মুসলিম বিশ্ব এক হয়েও ইহুদিদের বিরুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা নেই। মুসলিম জাতি নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে তা-ও ইহুদী তথা পশ্চিমাদের তৈরি। নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিকশিত না করে শুধু ঈমানী চেতানায় যে ফল বয়ে আনে না তা বিগত একশ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে আর মুসলিমরা বসে আছে আবাবিল পাখির আশায়। আফসোস! মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ ইহুদী ১৬০ কোটি মুসলমানকে আজ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষনার শক্তি দিয়ে, কোনো অলৌকিক শক্তি দিয়ে নয়। কোয়ান্টিটি দিয়ে কী হবে যদি কোয়ালিটি না থাকে! এবার হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের সমীকরণ মেলান।
লেখক: প্রাবন্ধিক