হজের খরচ ‘বহনযোগ্য’ করতে সমস্যা কোথায়?

10

নিজস্ব প্রতিবেদক

হজে যাওয়ার জন্য ঘোষিত প্যাকেজের খরচ ‘অযৌক্তিক’ বলছেন হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা। যৌক্তিক খরচ নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগ্রহ থাকার পরও নিবন্ধন করতেও সাহস পাচ্ছেন না ইচ্ছুক ব্যক্তিরা। হজ খরচ কমানোর যৌক্তিক দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রিটও করা হয়েছে।
এ অবস্থার মধ্যে নিবন্ধনের সময় শেষ হয়েছে কোটা অপূর্ণ রেখেই। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ পোর্টালের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার তথ্য অনুযায়ী, এক লাখ ১০ হাজার ৩৪৬ জন নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে সরকারিভাবে ৯ হাজার ৬৮৩ জন এবং বেসরকারিভাবে এক লাখ ৬৬৩ জন নিবন্ধিত হয়েছেন। এখনো কোটা পূরণে বাকি আছে ১৬ হাজার ৮৫২ জন। কোটা পূরণ করতে আগামী ২১ মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধনের সময় বাড়ানো হয়েছে।
হজে যাওয়ার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন চন্দনাইশের মোহাম্মদ লোকমান। করোনার কারণে তিনি হজে যেতে পারেননি। তিনি জানান, ‘২০২০ সালে বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার সাধারণ প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা। এখন করোনার ভয় কেটেছে, হজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু এবার বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৭ টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে খরচ। সরকার খরচ না কমালে শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করা সম্ভব হবে না।’ ১ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি স্মারকলিপিতে ২০২৩ সালের হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালনের সর্বনিম্ন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কোরবানি ছাড়াই নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার উভয় প্যাকেজেই বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের হজের খরচের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে বিমান ভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। বিমান ভাড়াকে মাত্রাতিরিক্ত মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সাধারণভাবে ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা পথে একটি রাউন্ড ট্রিপে বিমানের টিকিটের মূল্য ধরা হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো। সেই তুলনায় হজ প্যাকেজের বিমানভাড়া দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। ওমরা পালন বা অন্য কোনো কারণে সৌদি আরবে যে ভাড়ায় টিকেট পাওয়া যায় হজের ক্ষেত্রে তার দ্বিগুণ বা বেশি নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে হজ প্যাকেজের ব্যয় বৃদ্ধি হজযাত্রীদের জন্য অবশ্যই চাপের। তবে এ আর্থিক চাপ যতটা সম্ভব কম রাখা যায়, সেই চেষ্টা চলছে। এ বছর বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়া ও পরিষেবা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলার ও সৌদি মুদ্রা রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে হজ পালনের খরচ বেড়েছে।
গত রবিবার হজের খরচ কমাতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়ার আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আল কোরআন স্টাডি সেন্টার সুপ্রিম কোর্টের কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট আশরাফ-উজ্-জামান। রিটে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও যেকোনো এয়ারলাইন্সের টিকিটে হজে যাওয়ার অনুমতি দিতে নির্দেশনা চান তিনি। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) রিটের শুনানিতে চলতি মৌসুমে ধর্ম মন্ত্রণালয় ঘোষিত হজ প্যাকেজকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশে হজের জন্য সরকার আলাদা বাজেট রাখে; কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। হজের প্যাকেজমূল্য অনেক বেশি হওয়ায় আমরাই হজে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আর সেখানে গরিব মানুষ কীভাবে যাবে।’
পরে আদালত হজের খরচ বাড়ার কারণ বিস্তারিত জেনে বুধবার ফের শুনানির আদেশ দেন। বুধবার ফের শুনানিতে হজ প্যাকেজের মূল্য কমানোর বিষয়টি সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সময় খরচ সহনীয় পর্যায়ে আনা যায় কি-না সেটি বিবেচনার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে নির্দেশ দেন আদালত। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিন ধর্ম মন্ত্রণালয় চলতি বছরে হজ প্যাকেজের দাম বাড়ানোর বিষয়ে হাইকোর্টের একই বেঞ্চকে ব্যাখ্যা দিয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডলারের দাম ও বিমান ভাড়া, বাসা ভাড়া এবং মোয়াল্লেম ফি বাড়ায় হজ প্যাকেজের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার চলতি বছর হজ ফ্লাইটের ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে বিমান বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কাশেম মুহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ২০২৩ সালের হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা নির্ধারণ করে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে হজযাত্রী, হজ এজেন্সি ও পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিনিয়তই ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসছে।
এদিকে বিমান ভাড়া কমানোসহ হজ প্যাকেজ থেকে সব ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার এবং ভর্তুকি দিয়ে হজযাত্রীদের খরচ সাড়ে চার লাখ টাকার নিচে আনার আহŸান জানিয়েছে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে এ আহŸান জানানো হয়।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির বলেন, ২০ মার্চের মধ্যে যদি এ বিষয়ে সন্তোষজনক সিদ্ধান্ত নেয়া না হয়, তবে আগামী ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হবে।
হজের খরচ কমিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা করা সরকারের দায়িত্ব হলেও তা না করে সিন্ডিকেট সদস্যদের লাভবান করতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ হজযাত্রীদের কষ্টের জমানো অর্থ দিয়ে বিমানের লোকসান কাটিয়ে লাভবান করতে প্রায় ১ লাখ টাকা বিমান ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলেও দাবি করেন শহিদুল ইসলাম কবির।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন হজ হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে এই বছর হজে যেতে পারবেন এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এদের মধ্যে সরকারিভাবে ব্যবস্থাপনায় যেতে পারবেন ১৫ হাজার ব্যক্তি, বাকিদের যেতে হবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়।
সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ পাবেন।