জহির সিদ্দিকী

যে কোন সমাজের ঐতিহ্যকে, মেধা, সংস্কৃতির বিকাশ ও লালনে ভাষা এক সর্বোকৃষ্ট মাধ্যম। ভাষা হল মানব হৃদয়ে লুকায়িত আবেগ এবং ভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরায় প্রত্যেক গোত্রের ভাষা অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন। সে ভিন্নতা নিজ মাতৃভাষার উপরও পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিচারপূর্বক প্রতিটি দেশের মাতৃভাষা নির্ধারিত। যেমন সৌদি আরবের মাতৃভাষা আরবি, পাকিস্তানের মাতৃভাষা উর্দু ইত্যাদি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশীদের জাতীয় জীবনে উদ্দীপ্ত চেতনার প্রতীক। এই মাসে এদেশের উদ্যমী, উৎসাহী, সংগ্রামী যুবকেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য করছে রাজপথ কাঁপানো মিছিল আর সংগ্রাম। জনগণের বাধ ভাঙ্গা সাহসকে শত্রæর শত বোমা, শতগুলি পারেনি দুর্বল করতে। তাদের স্বপ্ন ছিল একটিই রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। বলা যায়-
বাংলার ছাত্র জনতা
গড়েছিল একতা।
একটাই ছিল আশা
বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা।
যেহেতু বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। সেহেতু বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়াই যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বপ্ন ছিল উর্দু হবে সমস্ত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলার সাহসী সন্তানদের বিদ্রোহের অনলে সে স্বপ্ন ভেস্তে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আরো অনেকে তাজা বুকের রক্তকে ঢাকার রাজপথে বিলিযে দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেনি। তাদের সেই সংগ্রাম, সেই বিদ্রোহ বাংলার জাতীয় জীবনে এনে দেয় এক স্মরণীয় বিজয়। যা স্মরণ করি এভাবেই-
দিবে রক্ত, ছাড়বেনা রাজপথ
ছিল তাদের উদ্দীপ্ত শপথ।
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার
করছে সংগ্রাম বারংবার।
আত্মত্যাগে এনেছে বিজয়
যা কভু ভুলবার নয়।
অগণিত ভাষা সৈনিকের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা আমাদের নিজের ভাষার কথা বলতে, পড়তে ও লিখতে পারছি। সুতরাং প্রতিবছরই ২১ শে ফেব্রæয়ারি আমাদের দেশে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়। আনন্দের বিষয়, ২০০০ সাল থেকে তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পিছনে ধন্যবাদ প্রাপ্য কানাডায় বসবাসকারী কিছু বাংলাদেশীর। কানাডায় ভ্যাঙ্কুভারের জনাব রফিকুল ইসলাম ৮ জানুয়ারি, ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আননের কাছে একটি আবেদন করেন। জাতিসংঘের অফিস থেকে বিষয়টি একটি সংস্থার পক্ষ থেকে ইউনেস্কোর কাছে উত্থাপন করার কথা বলা হয়। জনাব রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী আবদুস সালাম ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজেস অব দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতির পক্ষ থেকে দশজন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত সাতটি ভাষায় লিখিত একটি আবেদন ইউনেস্কোর কাছে প্রেরণ করা হয়। ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প বিষয়ক মিসেস আনা মারিয়া সমিতিকে জানান, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয় যদি কোন সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় তবে ব্যাপারটি বিবেচনা করা যেতে পারে।’ অতঃপর জনাব রফিকুল ইসলাম শিক্ষা সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে বিষয়টি সম্বন্ধে শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করলে সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় এবং ইউনেস্কোর কাছে যথার্থভাবে প্রস্তাব পেশ করে। মোট ২৬টি দেশ এই প্রস্তাব সমর্থন করে। দেশগুলো হচ্ছে- ইতালি, কোৎ দ্যা ইভোরার, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ওমান, কায়রো, দ্বীপপুঞ্জ, গাম্বিয়া, ডোনিনিকান রিপাবলিক, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, প্যারাগুয়ে, ফিলিপাইন, বাহামা, বেনিন, বেলারুশ, ভানুয়াতু, ভারত, মাইক্রোনেশিয়ান ফেডারেশন, মালয়েশিয়া, মিশর, রামিয়া, লিথুয়ানিয়া, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, সিরিয়া ও হন্ডুরাস। আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে সর্বসম্মতভাবে ইউনেস্কোর প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন বাংলাদেশের প্রস্তাব মেনে নেয়। জগৎ সভায় ২১শে ফেব্রæয়ারি এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য এক অতীব গর্বের বিষয়। অন্যদিকে অযতœ ও অবহেলায় বহু ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এবং বহু ভাষা আজ বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন। ২১শে ফেব্রæয়ারির বিজয় শিখা শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রজ্বলিত যার প্রমাণ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদ্যাপন। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলতে পারি স্মৃতিবিজড়িত মহান একুশে ফেব্রæয়ারি জাতির কাছে স্মরণীয় এবং বরণীয় এক অধ্যায়।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক