সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ১৫ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিলে বলা হয় আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ করা হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রতীক বরাদ্দ করবেন ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনী প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি রোববার। তফসিলের পর আবারও আলোচনায় এসেছে- নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। বিএনপিসহ তাদের মিত্র বিরোধী দলগুলো তফসিল প্রত্যাখ্যান করে লাগাতর অবরোধ ও হরতালের ডাক দিয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আনন্দ মিছিল করেছে। তফসিলকে স্বাগত এবং প্রত্যাখ্যানের মধ্যে আবারও কথা আসছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। গতমাসে তফসিল ঘোষণার পর থেকে কিংবা মনোনয়ন বিক্রি শুরুর পর থেকে নির্বাচনকালীন সরকার দায়িত্ব পালন ও রুটিন কাজ করবে বলে সরকার পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছিলো কিছু দিন থেকেই। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হলেও সেই রোডম্যাপে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো রূপরেখা উল্লেখ করা হয়নি। তবে সংঘাত পরিহার করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সদয় হয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সমাধান খোঁজার আহŸান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তফসিল ঘোষণাকালে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সংসদের সাধারণ নির্বাচন সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হয়ে থাকে। সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদের বিধান মতে সংসদের মেয়াদপূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সংবলিত এ নির্দেশনা নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নিরপেক্ষ সহায়তা নিয়ে সম্পন্ন করে থাকে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আর স্পষ্ট করে কিছু বলেননি নির্বাচন কমিশন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও সকল দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ইস্যুতে শর্তহীন সংলাপের আহবান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে। কিন্তু দলগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে এ চিঠির তেমন কোন মূল্য কারো কাছে নেই। ্এর কারণও আছে। একদিকে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, অপরদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি। এক্ষেত্রে বিএনপি দাবি করেছে, বেগম খালেদা জিয়াসহ তাদের শীর্ষ নেতাদের জেল থেকে মুক্তি দিলে সংলাপ নিয়ে চিন্তা করা যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের এ দাবি কতটুকু সরকার আমলে নেয় তা দেখার বিষয়। তফসিল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের ট্রেনে আপনি উঠবেন না, ট্রেন কি থেমে থাকবে? নির্বাচনী ট্রেন মিস করলে কারও জন্য থেমে থাকবে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, এর বিকল্প নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্যের পর স্পষ্ট হওয়ার বাকি থাকে না, নির্বাচন তার গন্তব্যে যাত্রা করেছে। এতে দ্বিতীয় বিকল্প ভাবনা সরকারের নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলজিয়াম সফর শেষে দেশে ফিরে গত ৩১ অক্টোবর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনকালীন সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ কেমন হবে তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের নির্বাচনে নির্বাচনকালীন সরকার ২০১৮ সালের মতোই হবে। এসময় তিনি স্পষ্ট করেন যে, ২০১৪ সালে কিছু মন্ত্রী অন্যান্য দল থেকে নিয়োগ করেছিলাম। এরপর ২০১৮ সালে আর সেই পদ্ধতি করি নাই। এবারও সেভাবেই হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেলেন, নির্বাচন কমিশন যখনই তফসিল ঘোষণা করবে, তখন থেকে বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার। তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পর গত দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮ সালে) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হয়েছে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হচ্ছে। ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভার আকার ছোট করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন মন্ত্রিসভায় নতুন মুখও এসেছিল। তবে ২০১৮ সালে আর তা ছোট বা বড় হয়নি। এবারও ছোট হওয়ার আর আশঙ্কা নেই। আমরা আশা করি, সংবিধান অনুযায়ী চলমান সরকারের অধিনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ আপাতত নেই। তবে নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আমরা মনে করি, কমিশন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে। এজন্য সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতাই যথেষ্ট।