সুন্দরবনে বাঘের খাদ্যাভাব-পালাচ্ছে ভারতে

19

মুশফিক হোসাইন

দেশের বণ্যপ্রাণীর ইতিহাস জানতে হলে, শত বৎসর পূর্বের ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতিকথা ও গেজেটিয়ার ছাড়া অন্য কোন সূত্র নেই। শত বছর আগে বাংলাদেশে বনেবাদাড়ে প্রচুর বন্যপ্রাণী বাস করতো। বিড়াল গোত্রের বড় প্রজাতি ছিল ভরপুর। চিতাবাঘ, ডোরাকাটা বাঘ, সোনালীবাঘ, মর্মর বাঘ, মেছোবাঘ, মেঘলাবাঘ, কালোবাঘ, রয়েল বেঙ্গল, বাঘদাস সকলি দেখা যেত। ছিল চিতাবিড়াল ও বন বিড়াল। হালে চট্টগ্রাম, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, সুন্দরবন ছাড়া অন্য কোথাও নেই। রয়েল বেঙ্গল টাইগার একমাত্র সুন্দর বনেই বাস করে।
সুন্দর বনের বাঘ শুমারিতে নানা তথ্য বিভ্রান্তি আছে। কারো কারো মতে ৪০০টি, ১১৪টি এবং ১০৬টি। বাঘ শুমারীতে ‘পায়ের ছাপ’ ( চঁম সধৎশ)পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। উন্নত পদ্ধতির ফটো মনিটরিং এ ১১৪টি বাঘ গণনা করা হয়। বাঘ শুমারির জন্য জাতি সংঘ ও উন্নত বিশ্বের বেসরকারি সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। রাশিয়া কনভেনশনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ২০২২ সালে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। জাতিসংঘ এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কাজ করছে। সে লক্ষকে সামনে রেখে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৯ জুলাই ‘বাঘ দিবস’ পালিত হয়ে থাকে। উনিশ শতকে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিলো এক লাখের কাছাকাছি। বিংশ শতাব্দিতে এসে তার সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র চারহাজার। দ্রুুত হারে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিশ্বসংস্থা শংকিত। বাঘের নিরাপদ আশ্রয় ও সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য রাশিয়া কনভেনশন ও বাঘ শুমারির উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার, জাভা, ইন্দোনেশিয়ায়, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, নেপালসহ আরো কয়েকটি দেশে বাঘ দেখা যায়।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভায় সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে ‘গণ্ডার সংরক্ষণ ও গণ্ডাার শুমারি, সংক্রান্ত’ পুরানো আইন প্রত্যাহার বিষয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন যে, ‘খাদ্যের অভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশ থেকে অনেক বাঘ ভারত অংশে এসেছে। এই সংখ্যা কমবেশি ২৭টি। ভারতে অন্তত ২৭টি রয়েল বেঙ্গল বেড়েছে। আগে ভারতের সুন্দরবন অংশে রয়েল বেঙ্গল ছিল মাত্র ৯৬টি। জঙ্গলে খাবারের টান পড়লে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। মুখ্যমন্দ্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরীর বন কর্মকর্তাদের আহŸান জানান। এ ছাড়াও নৌকায় করে গভীর জঙ্গলে বাঘের খাদ্য সহজলভ্য করার নিমিত্তে হরিণ ও শুকর সরবরাহ কর্মসূচি চলমান রাখার নির্দেশ দেন। ভারতীয় বন কর্মকর্তারা মনে করেন নিয়মিত খাদ্য সরবরাহের কারণে ভারতের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। (সূত্র : সমকাল, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)।
খাদ্যের অভাবে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং পরিযায়ী হওয়ার কথা শতবর্ষ পূর্বে ব্রিটিস জীব বিজ্ঞানি বলেছিলেন। সাম্প্রতিক পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভার তথ্যে তা নিশ্চিত হওয়া গেল। সমস্যা হলো বাংলাদেশের সুন্দরবনে তো বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বাঘের জন্য খাবার সরবরাহ করা তো হয়ই না। উল্টো বন বিভাগ, আমলাসহ অসাধু কর্মকর্তা ও পেশাদার শিকারীরা বাঘের খাদ্য হরিণ, মোষ, শুকর নির্বিচারে হত্যা করে চলছে। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যৎসামান্য ধরা পড়লেও বেশিরভাগ অধরাই থেকে যায়। এছাড়াও আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অর্বাচীন কথাবার্তাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। প্রাক্তন বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছিলেন, ‘ বাঘের সংখ্যা কম হলে বুঝবেন পাশের দেশে বেড়াতে গেছে আর বেশি হলে জানবেন বেড়াতে এসেছে’। এটা রসিকতা নয় ভুলক্রমে সত্য ও বাস্তবতা স্বীকার।
বিখ্যাত পাখি বিজ্ঞানি বলেছিলেন, ‘মানুষ না বাঁচলে পাখি বাঁচবে কিন্তু পাখি না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না’। একইভাবে বন্যপ্রাণী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। বন্যপশু পাখি মানুষের দেয়া সীমারেখা মানে না। এরা খাদ্য, যৌনসঙ্গী ও আবাসস্থল আছে কি না তার উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব ঠিকানা নির্ধারণ করে থাকে। খাদ্য ও সঙ্গীর খোঁজে বহুদূর পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে। তাই প্রজননের সময় ভারত ও বাংলাদেশের বাঘসহ অন্যান্য পশুর যাতায়াত লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য যে, বাঘের প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। এ সময় তো অবশ্যই এবং খাদ্যের সহজলভ্যতার কারণেও বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘ পরিযায়ী হচ্ছে ভারতে।
ভারত তাদের বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিগত কয়েক বছর যাবত অরণ্য সংরক্ষণের উপর জোর দিচ্ছে। ফলে গত ১৪ বছরে ভারতে অভয়ারণ্যের সংখ্যা ২৮ থেকে ৫০ শে উন্নীত হয়েছে। ভারত চার বছর অন্তর অন্তর বাঘের শুমারি করে থাকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাঘ চিল যথাক্রমে ৭৬ ও ৮৮টি। ২০২০-২১ সালের সংখ্যা বেড়েছে ৯৬টি। সুন্দর বনের ৬০ শতাংশ প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। বাকী ৪০ শতাংশ যার আয়তন চার হাজার বর্গকিলোমিটার। সুন্দর বনে কয়টি পুরুষ ও মেয়ে বাঘ আছে, তার শুমারি নেই। সাধারণতঃ একটি বনে মোট বাঘের এক চতুর্থাংশ পুরুষ বাঘ। সর্বশেষ শুমারি মতে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ ছিল। সে হিসাবে সুন্দরবনে ৩০টি পুরুষ বাঘ থাকার কথা। ধারণা করা হচ্ছে বনে মেয়ে বাঘ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ফলে নিঃসঙ্গ পুরুষ বাঘ নারী সঙ্গীর খোঁজে ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করছে। ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যায় যে, প্রজনন মৌসুমে ভারতীয় সুন্দর বনের আশে পাশের লোকালয়ে বাঘের আনাগোনা বেড়ে যায়। প্রশ্ন হলো তারা বাঘ না বাঘিনী ? প্রজনন সময়ে পুরুষ বাঘ তীব্র স্বরে সঙ্গী অর্থাৎ বাঘিনীকে আহŸান করে। তার আহŸানে নারীবাঘ রাজী না হলে পুরুষ বাঘ টেরিটরি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। এ সময়েও বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। পরিযায়ী বাঘের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারলে বলা যাবে কারা যাচ্ছে। আবার বনে খাদ্য সংকট হলেও বাঘ অন্যত্র গমন করে থাকে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা বিচার করলে এ কথা নিশ্চিত যে সেখানে অনুকূল পরিবেশ নেই। ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনের ভেতরে স্থিত নদীতে নৌ-চলাচল, শিল্পকারখানা স্থাপন, অবৈধ শিকার, খাদ্য সংকটের কারণে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ বসবাসের পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)