সীমান্তে আইসের প্লাবন!

23

তুষার দেব

কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে শতভাগ মেথাম্ফিটামিনযুক্ত মরণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চোরাচালান অব্যাহত ছিল। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কল্যাণে(!) সীমান্তে আইসের রীতিমত প্লাবন ডেকেছে। বিদায়ী বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন বছরেও গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী সীমান্তে অভিযান চালিয়ে এক কেজি ৬৫ গ্রাম আইস এবং ১০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। জব্দকৃত এসব মাদকের আনুমানিক বাজারমূল্য পাঁচ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে এসময় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
মাদকের বাজার বিশ্লেষকসহ এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে উচ্চ মূল্যের আইসের চালান আসার পরিমাণ বছরের ব্যবধানে কয়েকগুণ বাড়লেও দেশের মাদকের বাজারে তার ব্যবহার এখনও অনেকেটাই কম। দাম বেশি হওয়ার কারণে এ মাদকের ব্যবহার এখনও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। চাহিদা কম হওয়া সত্বেও সীমান্ত পেরিয়ে বানের ¯্রােতের মত আইসের চালান দেশে নিয়ে আসার কারণ বা উদ্দেশ্য ভিন্ন। মূলত ভিন দেশে পাচারের জন্যই একের পর এক আইসের চালান দেশে নিয়ে আসছে মাদক পাচারকারী চক্র। মাদক মাফিয়ারা টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তকেই ক্রিস্টাল মেথ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার পূর্বদেশকে বলেন, গত দেড়-দুই বছরে ইয়াবার পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস আসার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। এ কারণে চোরাই পণ্য জব্দের তালিকায় উপরের দিকে উঠে এসেছে ক্রিস্টাল মেথ। সীমান্ত পরিস্থিতি যেরকমই থাক না কেন, মাদক চোরাকারবারি চক্র সবসময়ই সক্রিয় রয়েছে। বিজিবিও সীমান্ত ব্যবহার করে যে কোনও ধরনের অবৈধ কারবার প্রতিহত করতে তৎপর রয়েছে। বিজিবির তৎপরতার কারণেই ক্রিস্টাল মেথসহ চোরাই পণ্য জব্দের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কয়েকগুণ বেড়েছে। বিষয়টি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। সীমান্তের এ পাড়ে দেশের অভ্যন্তরে তালিকাভুক্ত মাদকের গডফাদারদের অনেকেই গ্রেপ্তার এড়িয়ে এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। আড়ালে থেকে তারাই মাদক ও মুদ্রা পাচারের কারবারে অর্থলগ্নি করছে। এ কাজে তারা রোহিঙ্গাদেরও ব্যবহার করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসার রুটকেই ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পরিবহনেও ব্যবহার করছে মাদক কারবারি চক্র। ইতিপূর্বে আইসসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদেও সেরকম ইঙ্গিতই মিলেছে। এ কারণে এই রুটের বিভিন্ন পয়েন্টে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস উচ্চমূল্যের মাদক। এখন পর্যন্ত উচ্চবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে এটির চাহিদা সীমাবদ্ধ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের অন্যতম প্রধান উৎপাদক দেশ হচ্ছে থাইল্যান্ড। একই সঙ্গে মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়াও উৎপাদন হয় ক্রিস্টাল মেথ। মূলত এই চার দেশ থেকেই এশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ক্রিস্টাল মেথ পাচার করা হয়। দেশে এখন পর্যন্ত জব্দকৃত আইসের চালানগুলো থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার হয়ে ঢোকার তথ্য রয়েছে। অভিজাত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের কদর বাড়ছে। ওই চাহিদাকে পুঁজি করে মিয়ানমারভিত্তিক ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট দেশে আইসের সরবরাহ ও বাজার তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। একসময় মিয়ানমার থেকে জল ও স্থল সীমান্ত দিয়ে কেবল ইয়াবার চালান দেশে ঢুকলেও চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন একই রুট ব্যবহার করে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চালান। নাফ নদী দিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে জেলের ছদ্মবেশে মাদক পাচারকারীরা সাগরে গিয়ে মিয়ানমারের মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে ইয়াবা ও আইসের চালান নিয়ে আসছে। এছাড়া উখিয়া সীমান্ত দিয়েও মিয়ানমার থেকে পাচারকারীরা সরাসরি মাদকের চালান দেশে এনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মজুদ করছে।
ডিএনসি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বদেশকে বলেন, দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বাজারে নিয়মিত ক্রিস্টাল মেথ বা আইস কিনে সেবন করার সামর্থ্য মাদকসেবীদের একটি বড় অংশের নেই। শুধুমাত্র অভিজাত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাদকসেবীরাই দেশের মাদকের বাজার থেকে আইস কিনে সেবন করছে। তবে যে পরিমাণ আইস দেশে ঢুকছে তা চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। তার মানে, ভয়ঙ্কর এই মাদক দেশের ভুখন্ড ব্যবহার করে বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্রের মত আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়ারা টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তকে ক্রিস্টাল মেথ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এখান থেকেই হয়তোবা এ মাদকের চালান বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়ে থাকতে পারে।