সন্তানেরা থাকুক নিরাপদে

19

ববি বড়ুয়া


‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার, বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার’- হায়দার হোসেন কন্ঠে গাওয়া গানটি সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর বুকের ভেতর একটা কেমন যেন চাপা কষ্টে গুমরে গুমরে দম বন্ধ হতে চাইছে। বারবার মনে হচ্ছে কী হচ্ছে আমাদের সামাজিক অবস্থার? দিন দিন কোন পথে হাঁটছি। যতোটা সভ্য হচ্ছে বিশ্ব; আমরা যেন ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছি। অনেকটা ববর্বর মধ্যযুগীয় কায়দায় এগুচ্ছি। কী তার কারণ? কী তার প্রতিকার ! আরোও অধিক পরিমাণে সভ্যতার চর্চা করার জায়গায় বর্বরোচিত পথে হাঁটছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা পত্রিকার পাতা উল্টালেই ছোট্ট শিশু আয়াতের নির্মমভাবে হত্যা হওয়ার খবর, একজন পিতার বুকের ধন তার কন্যার মৃত শরীরের খÐিত অংশ খুঁজে পেতে আহাজারি। যিনি বারবার বলছিলেন, ‘অন্তত আমার মেয়ের লাশটা খুঁজে দাও। দাফন করি।’ কী নির্মম, নিষ্ঠুরতম কান্নার আর্তনাদ! ছয় বছরের ছোট্ট আয়াত, কী ছিল তার অপরাধ ! কেন সে বাঁচার অধিকার পেল না? একটি মানবিক সমাজ এমন দৃশ্যে চুপ থাকতে পারে না। এতে তদন্তরত পুলিশ কর্মকর্তা যিনি নিজের আবেগ সংবরণ করতে না পেরে দিন রাত এক করে খুঁজে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন ছোট্ট শিশু আায়াতের শরীরের খÐিত কিছু অংশ। আয়াতের খÐিত ‘দুই পা’ উদ্ধারের পর যখন পিবিআই কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা তার পিতা সোহেল রানাকে সান্ত¦না জানাচ্ছিলেন, তখন তার আকুতি ছিল- ‘মেয়ের মাথাটা খুঁজে দেবেন? শেষবারের মতো একবার চেহারাটা দেখবো।’ আহ! কী হৃদয়বিদারক কাতর করা আর্তনাদ !
পত্রিকার অংশ তুলে ধরলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে সুবিধা হবে। আয়াতের হত্যাকারী ক্রাইম সিরিয়ালে আসক্ত আবির জানায়, কৈশোরকাল থেকেই টেলিভিশনে তার পছন্দের সিরিয়াল ছিল ‘ক্রাইম পেট্রল’ ও ‘সিআইডি’। একেকটি কাহিনী সে দেখতো আর নিজের মতো করে ভাবতো। অপহরণটা কিংবা খুনটা কীভাবে হলো, কীভাবে অপরাধীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিল, পুলিশ কীভাবে আসামির খোঁজ পায়-ইত্যাদি নানা বিষয় তার কিশোর মাথায় ঘুরপাক করতো সবসময়। কখনো সে নিজেকেই ভাবতো সিরিয়ালের অপরাধী, কখনো ভাবতো তদন্ত কর্মকর্তা। একসময় তার ইচ্ছে হলো বাস্তবে তা প্রয়োগ করার। নিজেকে অপহরণকারীর চরিত্রে বসিয়ে পরিকল্পনা করলো, শিশু আয়াতের চাইতে সহজ টার্গেটতো আর হতে পারে না। দুটো পরিবারের সুসম্পর্কের কারণে সন্দেহের তীর তার দিকে তাক করা হবে না, পাশাপাশি আয়াতের বাবার থেকে মুক্তিপণও আদায় করা যাবে। ১৫ নভেম্বর নিজের দক্ষতা প্রমাণের দিন ধার্য করলো আবির, যেদিন দেখলো আয়াত মাদরাসার মাঠে সাথীদের সাথে খেলছিল।প্রসঙ্গে আনা আবিরের বিষয়টি একটু বিষদে আলোচনা না করলে বোঝা যাবে না, একটি কিশোর মন কীভাবে নিজেকে অপরাধ জগতের বাসিন্দা করে তুলছে।
আমরা যেসব হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি তা আসলে আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক অবস্থারই প্রতিচ্ছবি। এসব আমাদের অবক্ষয় আর সামাজিক সংকটের চিত্র। ২০১৭ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০-৩২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি শিশু-কিশোর। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের অধিক প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু-কিশোর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ফলে অতি সহজেই তাদের যে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়াও যে বিষয়টি আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি, তা হলো আমাদের পারিবারিক শিক্ষা। অর্থাৎ পরিবারে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ, ভালোবাসা ও সঠিক আচরণ শিক্ষা, মাতা-পিতার একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধের অভাব। আর এর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার অভাব। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যেখানে আগে নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব বেশি দেয়া হতো ; বর্তমানে সেই জায়গায় একটু ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আরোও একটি বিষয় খুব প্রয়োজনীয় ;তা হলো সুষ্ঠু ধারার সংস্কৃতি চর্চার অভাব। কারণ সংস্কৃতি চর্চা মানুষের মেধা মননে মানবিক মানুষ ও উদারচেতা মানুষ হিসেবে গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। আরেকটি দিক আছে যা আমরা শিশুদের দোষ দিয়ে পারবো না। তা হলো সুস্থ শরীর ও মনের চর্চায় প্রয়োজন খেলাধুলা। আর এর জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত জায়গা; আমার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ড মাঠে ঘোষণা দিয়েছেন , তা হলো প্রতি জেলা, উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করবেন। তারপরেও বিষয়টি ভবিষ্যতের খাতায় থেকেই যায়। এসব এছাড়াও লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, ধনী গরীব নির্বিশেষে চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হচ্ছে; ফলে আত্মহত্যা ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। পারিবারিক কলহ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং, নির্যাতন, মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধুবান্ধব সামাজিক সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ছাত্র শিক্ষককে হত্যা ও লাঞ্ছিত করছে। যা এই সময়ে এসে বারেবারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব সামাজিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে তরুণ ও যুব সমাজ। অথচ তারা এই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ।
বিশিষ্টজনদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, আইন শুধুমাত্র আইনের খাতায় সীমাবদ্ধ থেকে তার যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও হবে বাড়াতে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতিও জোর দিতে হবে। যদি সন্তানদের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া যায় এবং তারা কী করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা। আর সরকারি বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার নিশ্চিতকরণ, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ খেলাধূলা ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করা হলে সামাজিক অপরাধের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। আমাদের কামনা, আয়াতের মতো ক্ষণস্থায়ী জীবন আর কারো না হোক। কোন পিতা মাতা আর সন্তানের ধর্ষণের, হত্যার বিচার চেয়ে কিংবা নিরাপত্তার দাবি তুলে ব্যানার হাতে না দাঁড়াক। সুজলা সুফলা শস্যে শ্যামল এই দেশে সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক