শেখ রাসেল : বিশ্বের অধিকার হারা শিশুদের প্রতীক

21

এমরান চৌধুরী

আগামীকাল শেখ রাসেল দিবস। দিনটি বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে। শেখ রাসেলের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ৪৫ বছর পর গত বছর থেকে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। শেখ রাসেল দিবস পালনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে শিশু অধিকার রক্ষায় যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালনের জন্য গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে দিবসটিকে ক শ্রেণিভুক্ত ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি সরকারের ডাক ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ গত বছর থেকে ৮ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের সৃজনশীল অবদানের স্বীকৃতি দিতে ‘রাসেল পদক ২০২১’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সী যে সব শিশু এসব বিষয়ে অবদান রেখেছে তারা এই সম্মাননার জন্য বিবেচিত হবে। দুটো উদ্যোগই প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে, সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণে ‘রাসেল পদক’ নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
শেখ রাসেলের কথা আসলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি নৃশংস, নির্মম, হৃদয়বিদারক ও রুদ্রশ্বাস সময়ের কথা। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ঘটনা দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমাদের জানা নেই। আমরা নিজেরা নিজেদের যতই সভ্য মনে করি না কেন এ ঘটনার পর পৃথিবীর কোনো দেশ আমাদের সভ্য ভাবার অবকাশ নেই। যে দেশ মাসুম শিশুসহ জাতির জনককে হত্যা করতে পারে সে দেশের মানুষ কখনো সভ্য বলে দাবি করতে পারে না। নিঃসন্দেহে আমরা বর্বর ও অকৃতজ্ঞ। অনেকে বলতে পারেন কয়েকজন বিপথগামী সেনাসদস্য কর্তৃক সংগঠিত বর্বরতার জন্যে আমরা কেন অসভ্য, বর্বর ও অকৃতজ্ঞ হিসেবে খ্যাত হব! কথাটা অযৌক্তিক নয়। তবে প্রাচীন প্রবাদকেও অস্বীকার করার উপায় নাই। ‘একে নষ্ট করে সবে কষ্ট পায়’ তাই আমরা পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যারা অত্যন্ত তীব্রভাষায় নিন্দা জানায়নি। পৃথিবীর দেশে দেশে অশুভ ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিরা ক্ষমতার জন্য সে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা, নির্বাসনের নজির আছে। কিন্তু নারী ও শিশুসহ পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যার নজির তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পাওয়া যাবে না, যা ঘটেছে বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীদের আলালের ঘরের দুলালের মতো দুধে-ভাতে লালন করা হয়েছে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। যে দেশে জাতির পিতার খুনি, মাসুম শিশু শেখ রাসেলের খুনি ও তাদের আত্মীয়রা দোর্দÐপ্রতাপে চলাফেরা করেছে সেই দেশের মানুষকে কোন মানদÐে সভ্য ও কৃতজ্ঞ বলা যাবে তা ব্যাপক বিশ্লেষণ ও ভাবনার বিষয়।
শেখ রাসেল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় আদরের ছোট ভাই। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর তার জন্ম। ছোটবেলায় তার নাম রাখা হয় রাসেল। রাসেল শব্দটা আমাদের জিভের ডগায় আসলে একজন দার্শনিকের নাম মনে পড়ে যায় —বার্ট্রাÐ রাসেল। যিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। রাসেল নামে সে বাড়ির সকলের কাছে আদৃত হলেও তার একটি ভালো নামও ছিল—শেখ রিসাল উদদীন। কিন্তু এই নামে তাকে কেউ জানে না, চেনেও না। স্কুলের খাতায় এই নামটি সীমাবদ্ধ ছিল। তার যখন চার বছর বয়স তখন তাঁকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। ভর্তি করানোর সময় তার আসল নামটি উঠে আসে। যদিও এই নামে স্কুলের রোল কল ছাড়া আর কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। বাসায় মানে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে মা-বাবা, হাসু আপুসহ সবাই তাকে রাসেল নামেই ডাকত। স্কুলের বন্ধুরাও তাই। তার আসল নামটি কখনো জিভের ডগায়ও তুলেনি কেউ। সবার কাছে প্রিয় ছিল রাসেল নামটি। কারণ এই নামটি বড় মায়াবী, হাতছানি দেওয়ার মতো নাম। শেখ রাসেলের স্কুলে ভর্তি ও নাম রাখা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদদীন লিখেছেন, চার বছরের মাথায় তাকে ইসকুলে ভর্তি হওয়ার কথা উঠল। ঠিক হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ইসকুলে ভর্তি করানো হবে। সবারই পছন্দ এই ইসকুলটি। কিন্তু ইসকুলে তার একটি ভালো নাম চাই। তিন অক্ষরের ছোট নামটি ডাকনাম হতে পারে। বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ে গেলেন। শেষমেশ রাসেল শব্দটি থেকে উৎসারিত হলো রিসাল এবং রিসালের শেষে উদদীন যোগ করে প্রকৃত নাম ঠিক করা হলো রিসাল উদদীন। ইসকুলের খাতায় গোষ্ঠী পদবী যোগ করে রাখা হলো শেখ রিসাল উদদীন (আমাদের রাসেল, মাসিক শিশু, অক্টোবর ২০১৫ পৃষ্ঠা-০৫)
বাড়ির ছোটছেলে হিসেবে সবার আদরের ছিল শেখ রাসেল। বাবা রাজনীতি করতেন। সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। এ কারণে বাবাকে খুব একটা কাছে পেত না রাসেল। কারণ বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই ছিল জেলখানা আর আটষট্টি হাজার গ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদের মতো। জেলখানা আর মাঠে-ময়দানই ছিল তাঁর বাড়িঘর। ফলে অন্য দশটা শিশু বাবার যে স্নেহ-মমতা পেত রাসেলের বেলায় তা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই তার সব আবদার বা বায়না ছিল হাসু আপুর কাছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল সাড়ে ছয় বছর। মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয়মাস এক মিনিটের জন্যেও সে বাবার সঙ্গ পায়নি। এই নয়টি মাস পরিবারের সদস্যদের সাথে তাকেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাহারায় বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে। এই অপ্রাপ্তি তাকে পরবর্তীকালে খুব আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে প্রায় সময় বাবার কাছাকাছি থাকার জন্য আবদার করত, জেদ ধরত। ফলে বাবার সাথে তার লন্ডন, মস্কো, জাপানসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবার সুযোগ হয়েছে। এসব জায়গায় সে বেশ আনন্দ পেয়েছে। তবে রাসেলের বিনোদনের একটা প্রিয় জিনিস ছিল সাইকেল। সে সাইকেলে চড়ে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে নিজে নিজে আনন্দে মেতে উঠত। টুঙ্গিপাড়া বেড়াতে গেলে তার সময়টা বেশ ভালো কাটত। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরে সে বেশ মজা পেত আর ঘুরে বেড়াত আম বাগানে। বাগানে নানা জাতের আম দেখে খুশিতে মাতোয়ারা হতো।
রাসেল ছিল রাজার ছেলে —রাজপুত্তুর। রাষ্ট্রপ্রধানদের ছেলেদের তাই হওয়ার কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেমন দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও সরকারি সুরক্ষিত বাসভবনে না থেকে নিজের সাধারণ বাড়িতে থাকতেন তাঁর সন্তানরাও ছিল তেমন সাধারণ। রাসেল পড়াশোনা করত একটি সাধারণ স্কুলে। স্কুলের সব ছাত্ররা ছিল তার বন্ধু। সবার সাথে সে প্রাণ খুলে কথা বলত। সাধারণের সাথে মিলেমিশে থাকার, চলার এই গুণটি সে জন্মগতভাবেই পেয়েছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় রাসেল নামের ফুলটি বিকশিত হওয়ায় আগেই ঝরে পড়তে বাধ্য হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। একদল অকৃতজ্ঞ বাঙালি অত্যন্ত নির্মমভাবে পরিবারের সকল সদস্যকে খুন করার পর এই মাসুম শিশুর (যাকে আমরা বলতে পারি স্বর্গের প্রজাপতি, কারণ মাসুম শিশুমাত্রই স্বর্গের প্রজাপতি) কচিবুকটি ঝাঁঝরা করা দেয় অত্যন্ত পৈশাচিক কায়দায়। রাসেলকে হত্যা করার আগে জালিমরা মাসুম শিশুটিকে বাবার লাশ, মায়ের লাশ দেখায়। এসব দেখে সে ঘাতকদের কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলেছিল, ‘আমাকে হাসু আপুর কাছে পাঠিয়ে দিন’। কিন্তু ঘাতকদের কর্ণ কুহরে সেই মিনতি পৌঁছা দূরে থাক বিন্দুমাত্র মায়ার সঞ্চার হয়নি। আসলে মানব যখন দানব হয় তখন তার সকল শুভবোধ লোপ পায়, যেমনটি পেয়েছিল ঘাতকচক্রের।
রাসেলের জন্মমাস অক্টোবর। আবার এই মাসেই পালিত হয় বিশ্বশিশু দিবস। তাই এই মাসেই শেখ রাসেল দিবস পালনের ঘোষনা দেশের সকল শিশুর জন্যে একটি শুভ সংবাদ বলে মনে করা যায়। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী রাসেল যে সুযোগ পাওয়ার কথা তা পায়নি। নরপিশাচররা তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে মাত্র ১০ বছর ১০ মাসেই তার জীবন প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তার বদলে আমরা অজগ্র বুলেটে তার কচি বুক ক্ষত বিক্ষত করেছি।
বাংলাদেশের আর কোনো শিশু যেন রাসেলের মতো ঝরে না পড়ে তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সার্থক হবে শেখ রাসেল দিবস পালন। কারণ শেখ রাসেল এখন বিশ্বের অধিকারহারা শিশুদের প্রতীক। তাই শেখ রাসেল দিবসে আমাদের সোচ্চার হতে হবে নিখিল পৃথিবীর শিশুদের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য। শিশুর জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণে এরচেয়ে বড় কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক