বিভাস গুহ
শারদীয় দুর্গোৎসব সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে এ উৎসব মহাউৎসবে পরিণত হয়। শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে এর নাম শারদীয় দুর্গোৎসব। বিশ্ব সংস্কৃতি বিভাগের সেরা উৎসবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এই শারদোৎসবকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। শরৎকাল আসলেই সনাতনীদের ঘরে ঘরে জেগে উঠে আনন্দের হিল্লোল। অন্তরে অন্তরে অনুভব করে ঢাক ঢোল কাঁসা শঙ্খ ঘন্টার আওয়াজ। প্রতি ঘরে ঘরে বেজে উঠে বীরেন্দ্র ভদ্রের কন্ঠে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু মাতল রে ভূবন’। মৃৎশিল্পীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতীমা নির্মাণে। চতুর্দিকে যেন সাজ সাজ রব মা দুর্গাকে বরণ করার। কাশ ফুলের হাওয়ায় দােলে শিশির ভেজা শিউলি ছড়ানো পথে মা দুর্গার আগমনীতে স্বর্গীয় অনুভূতি যেন দোলা দিয়ে যায় প্রাণে মনে। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচণা। মহালয়ার পর থেকে মূলত শুরু হয় দেবীপক্ষ। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হয় বোধন। অকালের পূজা বলে করতে হয় বোধন। শাস্ত্রমতে সমস্ত বছরকে দুটি কালে ভাগ করা হয় উত্তরায়ন এবং দক্ষিণায়ন। মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যস্ত সময়কালকে উত্তরায়ন এবং শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত সময়কালকে দক্ষিণায়ন কাল বলে। দক্ষিণায়ন কাল হচ্ছে দেবতাদের জন্য নিদ্রার কাল আর উত্তরায়ন কাল হচ্ছে জাগ্রত কাল। যেহেতু আশ্বিন মাস দক্ষিণায়নে তাই দেবতারা এ সময়ে থাকে নিদ্রিত। দেবীকে জাগ্রত করার জন্য বোধনের প্রয়োজন। বোধনের জন্য ষষ্ঠি তিথিতে বেলগাছের নিচে মহাদেবের স্তব করে অনুমতি নিয়ে বোধন করা হয়। তাই শারদীয় দুর্গাপূজাকে অকালবোধনও বলা হয়। বোধনের মাধ্যমে শুরু হয়ে দুর্গাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহাঅষ্টমীতে কুমারী পূজা করা হয় কুমারীকে দেবীরূপে আরাধনা করা, মহাঅষ্টমী এবং মহানবমী তিথির সন্ধিলগ্নে করা হয় সন্ধিপূজা, মহানবমী পূজা সমাপন করে বিজয়াদশমী তিথিতে বিজয়ার অঞ্জলি প্রদান করে প্রতীমা নিরঞ্জনের মাধ্যমে শেষ হয় শারদীয় দুর্গোৎসবের। শারদীয় দুর্গোৎসবে সামাজিক স¤প্রীতির অপূর্ব এক মেলবন্ধনের চিত্র আমরা দেখতে পাই। প্রতিটি স¤প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ এ পূজার অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। কামার, কুমার, তাঁতী, শিল্পী, বাদক, বণিক, ব্রাহ্মণ সকল স¤প্রদায়ের মিলিত এক রূপ যেন শারদীয় দুর্গোৎসব।
বর্তমান সমাজের মানুষ যেভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে সেক্ষেত্রে শারদীয় দুর্গোৎসব সকল স¤প্রদায়ের মানুষকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার মিলনের অকৃত্রিম প্রয়াস। শারদীয় দুর্গোৎসবে প্রতিটি পরিবারের শিশু কিশোর আবাল বৃদ্ধ বণিতা নতুন পোশাক পরিধান করে ছুটে যায় মন্দিরে। মায়ের পায়ে অঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে প্রার্থনা জানাই অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শুভ শক্তি জাগরণের। দুর্গাপূজার মূল তত্বে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত শুভ শক্তির (দেবতাদের)সম্মিলিত রূপের প্রতীক মহাশক্তিরূপে মা দুর্গাকে দেখতে পাই। আর অপরদিকে অশুভশক্তিকে(অসুর) বিনাশ করে পদদলিত করতে। আর মা দুর্গার মাথার উপরে শিবকে (মঙ্গলময়) ধারণ করতে। অসুরকে পদদলিত করতে পারলে মঙ্গলময়কে শিরে ধারণ করা যায়। এটাই দুর্গাপূজার মূল তত্ত¡।
সমাজে যখন অশুভ শক্তির দাপট বেড়ে যায় তখনই শুভ শক্তি একত্রিত হয়ে মহাশক্তির সৃষ্টি হয়ে অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার শিক্ষা আমরা ইতিহাস থেকেও পেয়ে থাকি।
মা দুর্গার শরণাগতি হয়ে সকলের প্রার্থনা দুঃখ দুর্গতি নাশ হয়ে সুখ শান্তিতে যেন ভরে উঠে প্রতিটি পরিবার। স্বার্থের শৃঙ্খল ছিন্ন করে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে জেগে উঠে যেন প্রতিটি মানুষ। মা দুর্গার চরণে আমাদের এটাই হোক প্রার্থনা।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক