রাঙামাটিতে শহীদদের বধ্যভূমি সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ

29

রাঙামাটি প্রতিনিধি

রাঙামাটি- সদর ও জেলায় সরকারিভাবে কোথাও বধ্যভূমি নেই। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাসহ এদেশের বহু নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষকে হত্যা করে রাঙামাটি সদরের আশেপাশে একাধিক স্থানে গণকবর দিয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেইসব গণকবর শনাক্ত করে বধ্যভূমি গড়ে তোলা হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী রাঙামাটি সদরের সিরাজভান্ডার রুপনগর এলাকায় (বর্তমান বিএম ইনস্টিটিউট সংলগ্ন এলাকা) একটি গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছিল বলে জানান তৎকালীন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেখানে সরকারিভাবে বধ্যভূমি গড়ে ওঠেনি। সম্প্রতি স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গাছড়া নামক স্থানে এ ধরনের একটি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, সরকারের নির্দেশনা না পাওয়ায় রাঙামাটিতে বধ্যভূমি নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদার বাহিনী অসংখ্য মানুষকে হত্যার পর রাঙামাটি সদর, কাপ্তাইসহ বিভিন্ন জায়গায় গণকবর দিলেও এসব স্থান শনাক্ত করে বধ্যভূমি নির্মাণ ও সংরক্ষণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যুদ্ধ পরবর্তী দীর্ঘদিন পর রাঙামাটি সদরের বর্তমান বিএম ইনস্টিটিউট সংলগ্ন এলাকায় একটি গণকবর চিহ্নিত করা হলেও সেখানে আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে বধ্যভূমি গড়ে তোলা হয়নি।
সম্প্রতি কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গাছড়া নামক স্থানে উপজেলা প্রশাসনকে এ ধরনের একটি গণকবরের সন্ধান দিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা সেখানে বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, সম্প্রতি রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ৫নং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ওয়াগ্গাছড়া নামক পাহাড়ের পাদদেশে একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন হাজারের অধিক বাঙালিকে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা হতে তাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা গুলি করে হত্যার পর গণকবর দিয়েছিল বলে জানান- শহীদ পরিবারের সদস্য ও কাপ্তাই উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা দীপক ভট্টাচার্য, মিলন কান্তি দে, গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাসসহ সেই সময়ের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় নিহত নলিনী রঞ্জন দে, নিকুঞ্জ বিহারী দে, রায় মোহন ঘোষ, পরান ভট্টাচার্য, বিজয় ভট্টাচার্য, রেবতি ভট্টাচার্য, সুর্য্য চন্দ্র দে, পাইসু মারমাসহ অনেক শহীদদের নামও উল্লেখ করেন।
গৌরাঙ্গ মোহন বিশ্বাস জানান, যুদ্ধকালীন তার বয়স হয়েছিল পনের বছর। তার বাবা ক্ষিরোদ চন্দ বিশ্বাস চাকরি করতেন তৎকালীন রুহিনী মহাজনের ওয়াগ্গা চা বাগানে। তাদের বসতবাড়ি ছিল বর্তমান ৪১ বিজিবি ক্যাম্পের স্থানে। যুদ্ধকালীন ওয়াগ্গাছড়ায় একটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গা হতে বাঙালিদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেই ক্যাম্পের পাশে ওয়াগ্গাছড়া খালের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলিতে হত্যা করে ওয়াগ্গাছড়া খালে ফেলে দিত। আবার কিছু লোককে ক্যাম্পের পাশে একটা পাহাড়ের খাদে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তাদেরকে দিয়ে গর্ত করে সেখানে পুঁতে ফেলত। এভাবে পাক হানাদারদের বর্বর গণহত্যার বর্ণনা দেন তৎকালীন অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও। পাক বাহিনীর সেই গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্যরা ওয়া¹াছড়া এলাকার বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণসহ রাইখালী এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে একটি লিখিত দাবিনামা উপস্থাপন করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শনে যান কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান বলেন, ৫ ডিসেম্বর ওইসব শহীদ পরিবারের সন্তানরা ওয়া¹াছড়াকে বধ্যভূমি চিহ্নিত করার দাবিতে একটা চিঠি দেন। এর পরপরই আমি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, ওয়া¹া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে এলাকাটি পরিদর্শনে যাই। বিষয়টি আগে কেউ আমাকে অবগত করেননি। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং গণ্যমান্য লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে ওই এলাকায় একটি স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা যায় কি না- তা আমার চেষ্টা থাকবে।
রাঙামাটিতে বধ্যভূমি নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাঙামাটিতে সরকারিভাবে স্বীকৃত বধ্যভূমি নেই। আর তাই বধ্যভূমি নির্মাণের জন্য সরকারি নির্দেশনাপত্রও পাওয়া যায়নি।