মামলার তদন্তে ত্রুটির বিস্তার

7

তুষার দেব

অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের দমনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নির্ধারিত সময়ে মামলার বিচার এবং প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি। আদালতে প্রতিটি মামলার বিচারে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট (সিএস)। কিন্তু, গত কয়েকবছর ধরে চট্টগ্রামে ‘সাধারণ’ কিংবা ‘চাঞ্চল্যকর’ হিসেবে বিবেচিত মামলার তদন্তে দুর্বলতা বেড়েই চলেছে। তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি আদালতে জমা পড়ছে অপূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদন। এমনকি পুলিশের ওপর হামলার মামলায়ও প্রশ্নবিদ্ধ এবং দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। নগরী ও জেলায় সংঘটিত অপরাধমূলক ঘটনায় দায়ের হওয়া বেশ কয়েকটি মামলার নথি পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিরাজমান পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতে দ্রুততম সময়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যে কোনও মামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্পন্ন করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আদালত ভবনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেব্নুনেছা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ তাগিদ দেন।
আদালত সূত্রে পাওয়া পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে পুলিশের জমা দেয়া প্রায় দুইশ’ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন বা সিএস ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কেবল মহানগরীতেই অর্ধশতাধিক মামলার প্রতিবেদন দায়সারা ও প্রশ্নবিদ্ধ বিবেচনায় অধিকতর তদন্ত চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। মামলা তদন্তে গাফিলতির অভিযোগে দায়িত্বপালনকারী কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি চেয়েও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে আবেদন দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া, কোনও কোনও তদন্ত প্রতিবেদন ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা মামলা তদন্তের চেয়ে হয়রানিতেই বেশি মনোযোগী বলে বাদীপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। আর্থিক সুবিধা নিয়ে আসামিপক্ষের অনুকূলে প্রতিবেদন দেওয়ার অভিযোগও মিলেছে আদালতে দাখিল করা কয়েকটি নারাজি আবেদনে। এমতাবস্থায় মামলা তদন্তে থানা পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়েও বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠেছে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৭ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের ইতিহাসে কোকেনের সর্ববৃহৎ চালান ধরা পড়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া পৃথক দুটি মামলায় নগর গোয়েন্দা পুলিশের দাখিল করা দুটি চার্জশিটই প্রত্যাখ্যাত হয় আদালতে। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। এর মধ্যে মাদক আইনের মামলায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তার ভাইকে আসামি হিসেবে সম্পৃক্ত করে আদালতে সম্পূরক প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে সংস্থাটি। আর চোরাচালান আইনের মামলাটির অধিকতর তদন্ত চলছে। আদালত ডিবি প্রতিবেদনে বিস্ময় প্রকাশ করে আদেশে বলেন, চাঞ্চল্যকর একটি মামলার দায়সারা তদন্তের পর ত্রæটিপূর্ণ চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ ঘটনার পেছনে আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন। তাই অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মূল হোতাদের শনাক্ত করা উচিত। একইভাবে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের হরতাল চলাকালে জেলার ফটিকছড়ির ভূজপুরে আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিলে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া পৃথক পাঁচটি মামলার মধ্যে ২০১৪ সালের ১১ জুন নিহতদের পরিবারের করা তিনটি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করে ভূজপুর থানা পুলিশ। কিন্তু ত্রæটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগে তিনটি প্রতিবেদনই আদালতে প্রত্যাখ্যাত হয়। বর্তমানে মামলা তিনটি অধিকতর তদন্ত করছে সিআইডি। নগরীর কাজীর দেউড়িতে ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় শিবির নেতাকর্মীরা। হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এসআই আল আমীন। কিন্তু বিচার শুরুর আগে প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তাতে নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি দেখতে পান আদালতে নিযুক্ত অতিরিক্ত পিপি। এরপর তিনি আদালতে এসব অসঙ্গতি উল্লেখ করে অধিকতর তদন্ত ও গাফিলতির অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি চেয়ে আবেদন করেন। গত পাঁচ বছরে এরকম প্রায় দুইশ’টি মামলায় পুলিশের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে ত্রুটি পেয়েছেন আদালত। যার ফলে এসব মামলার অধিকতর বা পুনঃতদন্ত চলছে আদালতের নির্দেশে। বিগত ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মামলার বাদীপক্ষের নারাজি আবেদনসহ চার্জশিটে ক্রটি থাকায় একশ’ ৪২টি মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। যার মধ্যে একশ’ ১৯টি অধিকতর কিংবা পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র‌্যাব-সিআইডি-পিবিআই- এর মত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোকে।