‘মানবতার সংকট’ দেখলে বেদনার অনুভূতি কাব্য হয়ে উঠে : হাফিজ রশিদ খান

330

মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবতার সংকট কিংবা মানুষের বিপন্ন হয়ে পড়া কবিকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ যখন তার দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে সংকটে পড়েন; তা সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক-রোহিঙ্গারা যখন নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করে দলে দলে আরেক দেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তখন মানবতার ‘সত্যিই বড় বিপর্যয়’ দেখেন কবি। মানবতার সেই বিপর্যয়, সেই সংকট তাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলে, তিনি দুঃখ অনুভব করেন নিজের মতো করে, বেদনায় আন্দোলিত হয় কবির হৃদয়। বেদনার সেই অনুভূতি কাব্য হয়ে বেরিয়ে পড়ে সাহিত্যের সংসারে-হয়ে উঠে কবিতা।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক কবি হাফিজ রশিদ খান তার লেখালেখি সম্পর্কে এভাবেই তুলে ধরলেন নিজেকে। এবার অমর একুশে বইমেলায় তার ষোলতম কাব্যগ্রন্থ ‘রাতে আমার পেখম মেলে’ প্রকাশিত হয়েছে।
নিজের লেখালেখি এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি হাফিজ রশিদ খান যেন নিজের পেখমই খুলে দিলেন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি একজন অনুভূতি প্রবণ মানুষ হিসেবে, একটি সুন্দর-মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিকতার সংকট থাকবে না। সেই স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণে মানুষের মাঝে মানবিকতা আর ভালোবাসার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতেই লেখালেখি করছি। গত তিন দশক ধরে আমি অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প লিখেছি এবং গবেষণা করেছি। এ পর্যন্ত আমার ১৬টি কবিতার বই এবং ১০ গদ্যবই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা আর লেখালেখির বিষয়বস্তু হিসেবে
বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের মানবিকতা যাতে জাগ্রত হয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মানুষ সম্পর্কে ইতিবাচক বোধের জাগরণ সৃষ্টি করা এবং সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা।
মানবতার বিপর্যয় দেখে কবির হৃদয় বেদনায় আহত হয়, আবার কেউ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে দেখলে তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত হয় কবি হাফিজ রশিদ খানের। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যখন দলে দলে নিজের দেশত্যাগ করে আমাদের দেশের সীমান্তে আসছিল, তাদের জন্য আমার হৃদয় কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা যখন তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে মানবতার শ্রেষ্ঠ পরিচয় দিয়েছেন তখন ওই মানুষগুলোর দুর্দশায় পাশে দাঁড়িয়েছেন দেখে শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেল। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা-মানবিকতা এমনই হওয়া উচিত। সে সময়ে আমি আমার দেশ এবং মানবতার এই উদাহরণ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি- ‘ফিরে এসো আমার কাছে’ শিরোনামে।’
‘সনির্বন্ধ প্রার্থনা আমার
ফিরে এসে হে স্বদেশভূমি আমার আশার অশেষ ভান্ডার
ফসলের হাসিভরা চাষার সুন্দর ঘরে।
ভাটির উদাস মাঝিদের প্রাণের খবরে।’…
কবি হাফিজ রশিদ খানের এই কাব্যগ্রন্থে ৫৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতায় ফুটে উঠেছে কবির মানবিক চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ। নাম ভূমিকার কবিতাটিতে কবির অনুভূতি প্রবণ মনের আকুতিই যেন বেরিয়ে এসেছে কলমের ডগায়। কবি বলছেন :
‘সকলে ঘুমিয়ে গেলে
রাতে আমার পেখম মেলে
জানালার গ্রিলের সামান্য ফাঁকে শরীর গলিয়ে
লাফ দিয়ে নামি বেড়ালের মতো
চারদিক দেখি লুকিয়ে লুকিয়ে।’
চারদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলে, আরও গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে, অন্ধকার সুনসান নীরবতায় কবির হৃদয় পৃথিবীর কষ্টে থাকা মানুষের দুর্দশার আওয়াজ শুনতে পায়, তাদের কষ্টে বেদনাহত হয়ে পেখম মেলে দেন, বেড়ালের মতো চারদিক দেখেন কী সংকটে ছেয়ে আছে মানুষের সংসার। তা নিয়েই কাব্য উঠে আসে কবির কলমে।
এবার কবি সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলি। নিভৃতচারী এ কবির স্থায়ী নিবাস চট্টগ্রাম নগরীর শুলকবহর এলাকায়। একুশ বছর বয়সেই তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবনধারা ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করছেন কবি হাফিজ রশিদ খান। বহুল আলোচিত ‘আদিবাসী কাব্য’ (১৯৯৭) তাকে দিয়েছে আদিবাসী জীবনের কাব্যকার হিসেবে পরিচিতি। আদিবাসী সংস্কৃতির পরিচর্যায় ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ নামে ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। ‘পুষ্পকরথ’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন তিনি। তিনি চট্টগ্রামের সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার বার্তাবিভাগে কর্মরত।
পৃথিবীজুড়ে মানবিক সংকট আর মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অনুভূতি নিজের ভেতরে ধারণ আর লালন করে লেখা হাফিজ রশিদ খানের কবিতাগুলো বোদ্ধা পাঠকের হৃদয়ের খোরাক যোগাবে। ‘রাতে আমার পেখম মেলে’ বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। অমর একুশে বইমেলায় আগামী প্রকাশনীর স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।