মরক্কোর ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিতে হবে

5

তুরস্ক সিরিয়ার পর এবার মরক্কোতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে পুরো পশ্চিম আফ্রিকা। শক্তিশালী এ ভূমিকম্পে নিহত হয়েছে প্রায় দেড় হাজার ঘুমন্ত মানুষ। যত উদ্ধার কাজ চলছে হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গত শুক্রবার রাত আনুমানিক ১১টায় ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে এমন ভয়াবহতা বিগত একশ বছরেও দেখেনি দেশটির মানুষ। বিশেষজ্ঞরা একে এ অঞ্চলের ১২০ বছরেরও মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প বলে উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ শোক জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। এদিকে মরক্কোর ভয়াবহ ভূমিকম্পে যখন হতাহতের হিসাবনিকাশ চলছে, তখন শনিবার বিকালেও সিলেটে ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, চট্টগ্রামেও মৃদু ভুমিকম্প অনুভূত হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম। চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে প্রায় সময়ই ঘটা এমন ভূমিকম্প যেন এ অঞ্চল যে ঝুঁকিতে রয়েছে, তাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, সা¤প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগটির পেছনে রয়েছে অ্যারাবিয়ান প্লেটটির উত্তরদিকে সরে গিয়ে আনাতোলিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দেওয়া। এদিকে বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলেও কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকাও ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন ভূতত্ত¡ বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ-চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক, কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। এ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলো ঢাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রিখটার স্কেলে যদি ৭ কিংবা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে রাজধানীতে ঘটতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। গবেষণা বলছে, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হতেই পারে। জাতিসংঘও বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ভূমিকম্প তো দুরস্ত, সাধারণ ভবন ধসের মতো দুর্যোগ সামাল দিতেও আমাদের বেগ পেতে হয়। সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এর বাস্তব উদাহরণ।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকলেও ভূমিকম্পের বিষয়ে কোনো ধরনের তিক্ত জ্ঞান আমাদের নেই বললেই চলে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হওয়া সত্তে¡ও সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের মানুষকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের তিক্ত স্বাদ পেতে হয়নি; কিন্তু গত দুই শতাব্দীর ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন মেঘালয়ের শিলংয়ের কাছে যে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছিল, তার ফলে বর্তমানে পরিচিত ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ অনেক শহরের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, প্রাণ হারায় বহু লোক। বিজ্ঞানীদের মতে, তেমনটা ঘটতে পারে যেকোনো সময়। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখন আসবে তা আগাম জানা সম্ভব নয়; কিন্তু আমাদের মরক্কো, তুরস্ক, ইরান, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভূমিকম্পের শঙ্কা মাথায় নিয়েই আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় একদিকে রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে; অন্যদিকে শক্ত অবকাঠামো গড়তে বিল্ডিং কোড অ্যানফোর্সমেন্টকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া সচেতনতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচারণা এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধক বৃক্ষরোপণে মনোযোগ দিতে হবে।