গতকাল ১৫ মার্চ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয়েছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ‘নিরাপদ জ্বালানী ভোক্তা বান্ধব পৃথিবী’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালিত হলো বুধবার। যদিও বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন। একদিকে সরকার নির্ধারিত দামে ভোক্তারা পণ্য ক্রয় করতে পারছে না, অন্যদিকে ভেজাল আর নকলে সয়লাব পণ্যবাজার। ওষুধ, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে এমন কোন জিনিসপত্র নেই যার ভেজাল বা নকল নেই। এছাড়া ডিজিটাল যুগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধেও ভেজাল ও নকলের অভিযোগ রয়েছে। অনলাইনে বলি আর অফলাইনের বলি যেকোন পণ্য কেনাকাটায়ও বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ ভোক্তা। যেখানে আসল-নকল কিংবা দামের মারপ্যাঁচে প্রতিনিয়ত ক্রেতাকে ঠকানো হচ্ছে। অর্থাৎ সবখানেই ভোক্তা বঞ্চনার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। থেমে নেই ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রিও। ওজনে কারচুপি চলছে। বিক্রি হচ্ছে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে একে শুধু একটি দিনের কার্যক্রমে আবদ্ধ না রেখে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় সরকারকে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ভোক্তা একটি অর্থনীতির সম্পদ। এদের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
একুশ শতকের উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার যুগে নিরাপদ, মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক ভোক্তার অধিকার। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও ক্রমবিকাশমান বাজার ব্যবস্থাপনার দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ রোধ করা খুবই জরুরি। দেশের ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যতটুকু জানতে পারি, দেশের ১৬ কোটি ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল খুবই নগণ্য। জনবল সংকট থাকায় প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিংসহ ভোক্তা স্বার্থরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা অধিদপ্তরের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। আইন থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ, যা বাস্তবিকভাবে প্রমাণিত। শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের পাশাপাশি এটি যথার্থ জোরদার করতে হবে। কেননা আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আবার এ আইন মান্য করাও প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আইন প্রণয়নের ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভোক্তা তথা জনগণ এর সুফল পাচ্ছে, যদিও তা আশানুরূপ নয়। উন্নত দেশগুলোয় ভোক্তা অধিকারকে নাগরিকদের সাধারণ অধিকার হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এর মাধ্যমে নাগরিকের কাছে রাষ্ট্র আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও নাগরিক সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব তেমনভাবে পায় না, যার ফলে ভোক্তা অধিকারও প্রায় গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে। যদিও এ ধারণা বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের তাৎ্পর্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে ‘ভোক্তা অধিকার’ নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দেশে এখনো এটি অধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। বহুদিন থেকে তারা এ ধরনের আইন বাস্তবায়ন করার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ও জনগণ উভয়েই সুফল পেয়ে আসছে। নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়। একটি কার্যকর ভোক্তা আইনের ফলে সেসব দেশে জনস্বার্থ তথা ভোক্তা অধিকার আজ একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়। ব্যবসা-বাণিজ্য তথা ভোক্তা অধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিক্রেতারা যাতে কোনোভাবেই ক্রেতাদের ধোঁকা দিতে বা ঠকাতে না পারেন, সে লক্ষ্যেই ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের অধিকার রক্ষায় একটি কার্যকর আইন প্রণয়নের দাবি ছিল অনেক দিন থেকেই। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংসদ কর্তৃক গৃহীত ‘ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ ২০০৯’ আইনটি ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে এই আইনের প্রয়োগ যতটা হওয়ার কথা, ঠিক ততোটা দৃশ্যমান নয়। এর মূলে রয়েছে আইনটি সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। যার ফলে আইনটির যথার্থ প্রয়োগ হচ্ছে না। সরকারের পক্ষেও এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যার ফলে এই আইনের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ক্রেতারাও।
আইনের সুফল সব সময় নাগরিকের জন্যই এবং সেই আইনের সুফল ভোগ করার জন্য নাগরিককেই সচেতন হতে হয়, তা না হলে অসাধু শ্রেণি অন্যায়ভাবে সুবিধা নিবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতকরণে আইন প্রয়োগ, প্রশাসন ও নাগরিককে একই মাত্রায় কাজ করতে হবে এবং তাঁর মধ্যে নাগরিক তথা ভোক্তার ভূমিকা হবে অন্যতম নিয়ামক।