ভারত থেকে খালি হাতে ফিরিনি

15

ঢাকা প্রতিনিধি

বাংলাদেশ ভারত সফর থেকে কী পেয়েছে, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কী পেলাম, এই প্রশ্নটা খুব আপেক্ষিক। এটা আপনার নিজের ওপর নির্ভর করছে, আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন। তবে একেবারে খালি হাতে ফিরিনি।
চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী। সে সফর নিয়ে গতকাল বুধবার বিকেলে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও াসেময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ভারত সফর থেকে বাংলাদেশ কী পেল?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের চারদিকে কিন্তু ভারত। সেই বন্ধুপ্রতীম দেশ থেকে সবদিক দিয়ে যে সহযোগিতা…আমরা পাইপ লাইনের মাধ্যমে কিন্তু তেল নিয়ে আসছি। রিফাইন করা তেল সহজেই পাবে। উত্তরাঞ্চলের তেল সহজেই পাওয়া যাবে। পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। সব জায়গায় অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়, সেটা নিয়েও কথা হয়েছে। ভারতের কাছ থেকে যাতে এলএনজি আনতে পারি..এরকমভাবে যদি চিন্তা করেন, অনেক কিছু পেয়েছে। শূন্য হাতে ফিরে আসিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত সফরের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে সবাই খুব আন্তরিকতা দেখিয়েছেন।
সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, সফর শুরুর আগে দুটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সাক্ষৎকার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারে তিনি দুই দেশের সম্পর্কে ‘জেনেরোসিটি’ বা আন্তরিকতার প্রসঙ্গটি এনেছেন। সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই আন্তরিকতা উপলব্ধি করেছেন কিনা।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যথেষ্ট আন্তরিকতা পেয়েছি। যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন। তবে বড় কথা হলো বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল এক। যেমন আমাদের এখানে একাত্তরে সব দল মত এক হয়ে সমর্থন দিয়েছিল। আবার যখন আমরা আমাদের স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করি, যখন ছিটমহল বিনিময় করি, ভারতের পার্লামেন্টে যখন স্থল সীমান্ত বিল পাস হয়, সব দল মিলে কিন্তু আইনটা পাস করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধু। এবারের সফরে বাংলাদেশে উল্লেখ্যযোগ্য প্রাপ্তি হলো কুশিয়ার পানি বণ্টনে সমঝোতা।
তবে তিস্তা চুক্তির মত কিছু বিষয় যে আটকে আছে, সে দিকে ইংগিত করে সরকারপ্রধান বলেন, এটা বাস্তব যে, পাশাপাশি একটি দেশের সঙ্গে নানা সমস্যা থাকতে পারে। আমি সবসময় মনে করি যে, সমস্যাগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়।
শেখ হাসিনা বলেন, ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আসবে। ফলে তেল পরিবহনের খরচ অনেকটা কমে যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩১.৫৭ কিলোমিটার পাইপলিইন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১২৬.৫৭ এবং ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার পাইপলাইন ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ কাজ চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সহযোগিতা, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে ৭টি এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
তিনি বলেন, সফরের পুরো সময় জুড়ে আমরা ভারতের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ও সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে দু’দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছি। ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে, সংবাদ মাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি বাংলাদেশের জন্য যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য লক্ষ্য করেছি তা সত্যিই অসাধারণ। এই প্রীতির সম্পর্ককে সুসংহত করে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে ভারতের সহযোগিতা চেয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি কোভিড মহামারীর প্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর আমার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। সফরের পুরো সময় জুড়ে আমরা ভারতের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ও সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সমতা এবং শ্রদ্ধার ভিত্তিতে দুদেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছি।
ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে, সংবাদ মাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি বাংলাদেশের জন্য যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য লক্ষ্য করেছি তা সত্যিই অসাধারণ। এই প্রীতির সম্পর্ককে সুসংহত করে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই।
ভারত সফর থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়গুলোও প্রধানমন্ত্রী তার লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যার মাধ্যমে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে কাজ করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হবে।
চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দিতে ভারত সরকার পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতা সড়ক’ চালু করা হবে।
নদী দূষণ এবং অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে নদীর পরিবেশ এবং নদীর নাব্যতা উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্রæত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। রেলওয়ে সেবার মান বাড়াতে আইটি সল্যুশন বিনিময় করা হবে।
২০২২ সালের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে দুদেশের বাণিজ্য কর্মকর্তাদের কাজ শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সবাই নির্বাচনে অংশ নেবে সেটাই আমরা চাই
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই নির্বাচনে অংশ নেবে সেটাই আমরা চাই। আর যদি কেউ না করে, এটা যার যার দলের সিদ্ধান্ত। সেজন্য আমরা সংবিধান বন্ধ করে রাখতে পারি না। সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা চাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন যারা তত্ত¡াবধায়ক বা ইত্যাদি বলে চিৎকার করছে তারা ওয়ান ইলেভেনের কথা ভুলে গেছে? ২০০৭ এর কথা ভুলে গেছে? কী অবস্থাটার সৃষ্টি হয়েছিল? কী সাংবাদিক, কী রাজনৈতিক কর্মী, কী ব্যবসায়ী- সবার নাভিশ্বাস উঠেছিল। সেই অবস্থা থেকে তো সবাই অন্তত মুক্তি পেয়েছেন।

ভারত থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আসবে
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি করতে ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে তুলনামূলক স্বল্প সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস তেল, এভিয়েশন ফুয়েল আমদানি করা সম্ভব হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, জ্বালানি তেলের আমদানি উৎস বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে গত ২৮ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডকে (আইওসিএল) জিটুজি ভিত্তিতে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আইওসিএলের অন্তর্ভুক্তির ফলে তুলনামূলক স্বল্প সময়ে ও সাশ্রয়ী মূল্যে ডিজেল, অকটেন, ফার্নেস তেল, এভিয়েশন ফুয়েল আমদানি করা সম্ভব হবে। এতে দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

অর্থপাচার নিয়ে যা বললেন
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, দেশের অর্থ পাচারকারীদের তালিকা বহু আগেই সুইস ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছিল, তবে সেই তালিকা আসেনি।
শেখ হাসিনা বলেন, সুইস ব্যাংকে তো বহু আগেই আমরা আমাদের ডিমান্ড পাঠিয়েছিলাম। আমরা তালিকা চেয়েছিলাম। তালিকা কিন্তু আসে নাই, কেউ বলতে পারে নাই। সবাই বলে যায়, হাওয়ায় কথা বলে যায়। কিন্তু কেউ সঠিক তথ্য দিয়ে বলতে পারে না। এটা একটা সমস্যা, এটা আমরা দেখছি। মানি লন্ডারিং বন্ধ করার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ’
অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকেরই অর্থ পাচারের তথ্য আমার কাছে আছে, ওটা আপনারা (সাংবাদিকরা) লিখবেন কিনা সন্দেহ আছে। আমি সোজা কথা বলি, অনেকের ব্যাপারে অনেক স্বনামধন্যদের ব্যাপারেও আমার কাছে তথ্য আছে। তবে এটা দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ব্যাংকের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সামনে একদিন আসবে আপনারা লিখবেন কিনা আমি সেটা দেখব।