বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

5

এমরান চৌধুরী

মুসলমানদের প্রাণের ধর্ম ইসলাম। সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুরআন- এ দুটোর কোনটাই কিন্তু মানবজাতির কাছে এসে পৌঁছাতো না যদি না আবির্ভাব হতো সেই মহাপুরুষের। ১২ই রবিউল আউয়াল এ ধূলিধূসর পৃথিবীতে যাঁর আবির্ভাব তিনি আমাদের প্রিয় মহানবী। প্রিয় রাসূল। বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত। সৃষ্টি জগতের সেরা মহাপুরুষ। ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ। আল্লাহর প্রিয় হাবিব। লাখো গুণের আধার এ মহামানবের আবির্ভাব হয় ৫৭০ খৃষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে।
আরব দেশের একটি প্রধান শহরের নাম মক্কা। এই মক্কা শহরের বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (স)। তাঁর এ জন্মের মুহূর্তটি জাতীয় কবির গানে উঠে এসেছে ঠিক এভাবে :
তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে
যেন পূর্ণিমারই চাঁদ দোলে …
ঠিক তাই। পূর্ণিমার চাঁদের মতো যে শিশুর জন্ম তাঁর মায়ের নাম আমেনা। পিতার নাম আবদুল্লাহ। কিন্তু শিশু মুহাম্মদের বাবার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর পিতা মারা যান। এতে শিশু মুহাম্মদকে মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে তাঁর দাদা আবদুল মোতালিবের উপর। ছয় বছর বয়সে মাও শিশু মুহাম্মদ কে ছেড়ে চলে যান। এতে তিনি সম্পূর্ণ এতিম হয়ে পড়েন। ফলে জন্মে পিতৃহীন শৈশবে মাতৃহীন শিশুটির লালন পালনের ভার পড়ে তাঁর চাচা আবু তালেবের উপর। আমরা জানি, মানুষ মাত্রই আশরাফুল মওলুকাত- সৃষ্টির সেরা জীব। তখনকার আরবের লোকেরা মানুষের এ অসাধারণ গুণের কথা ভুলে সব সময় ঝগড়া বিবাদে মত্ত থাকত। তারা পানির মতো মদপান করত। জুয়া খেলত। সামাজিক স¤প্রীতি বলতে কোন কিছুই সে সমাজে ছিল না। তারা এমন এক ভয়ংকর সমাজ চালু করেছিল যাতে কোন ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাঁকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। ইসলামের ইতিহাসে সে সময়টাকে তাই আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কা’বা হলো আল্লাহর ঘর। যেখানে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হওয়ার কথা। তার বদলে সেখানে চলতো নানা দেব-দেবীর পূজা। সেখানে ৩৬৫টি দেব-দেবীর মূর্তি বসানো হয়েছিল। এক এক দলের ছিল এক এক দেবতা। আরববাসীর এরকম অধঃপতিত অবস্থা দেখে দেখেই বেড়ে উঠেন বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভাষা ছিল বেশ মিষ্টি। এমন মিষ্টি করে তিনি কথা বলতেন যে কেউ তাঁর কথায় বিমোহিত হতেন। কেউ কোনদিন তাকে মিথ্যা কথা বলতে শোনেননি। তাঁর কথা ও কাজে বিশ্বস্থতা ছিল অতুলনীয়। তৎকালীন
আরব সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার, ধর্মের নামে অর্ধম এসবের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল সব সময় অকুতোভয়। শৈশব-কৈশোর থেকে তাঁর কথাবার্তা, চাল চলনে আরববাসীরা তাঁর মধ্যে এমন অসাধারণ কিছু লক্ষ্য করেছিলেন যা তাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। ফলে তিনি আরববাসীর কাছে হয়ে উঠেন আল-
আমিন (বিশ্বাসী) আস-সাদিক (সত্যবাদী)।
জন্মের আগে পিতৃহীন, শৈশবে মাতৃহারা বালক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মক্কায় প্রচলিত রক্তাক্ত অন্যায় সমরের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সামাজিক আন্দোলনের সাংগঠনিক রূপ ছিল হিলফুল ফুযুল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই হিলফুল ফুযুল বা শান্তি সংঘ হলো প্রথম সামাজিক সংগঠন। মূলত এ সংগঠনের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ এর যুগ থেকে আলোর যুগে উত্তরণের কাজ শুরু করেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমান্বয়ে চিন্তাশীল হয়ে উঠেন। প্রায় সময় তিনি বাড়ির কাছের একটি পাহাড়ে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সেই পাহাড়টির নাম হেরা। সেই হেরা পাহাড়ে ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় একদিন তিনি জিবরাঈল ফেরেশতা মারফত শুনতে পেলেন আল্লাহর বাণী। সেই থেকে তিনি হলেন আল্লার রাসূল। নবুয়াত প্রাপ্তির পর থেকে তিনি পথ ভোলা মানুষকে সত্যের পথে ফেরার আহবান জানালেন। তিনি দেব-দেবীর পূজা ত্যাগ করে একমাত্র আল্লার ইবাদত করার কথা বললেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’। তাঁর এ আহবান তথা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয়ের কথাটা সহজভাবে নেয়নি তাঁর বংশের লোকেরা। তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নতুন ধর্মমতের কথা শোনে রেগে গেল। তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথা খারাপ হলো নাকি বলে খুব
শাসিয়ে দিল। শাসানোর পাশাপাশি তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে তাদের রাজা করার প্রলোভনও দেখাল। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাঁর লক্ষ্যে অবিচল। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা যদি আমার এক হাতে চাঁদ আর এক হাতে সূর্য এনে দাও, তা হলেও আমি আল্লাহ্ তায়ালার এই
সত্য ধর্ম প্রচারে এক বিন্দু পিছ পা হবো না।’
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বাগে আনতে না পেরে কুরাইশরা শুরু করলো তাঁর উপর নানা নির্যাতন। পথে ঘাটে যেখানে তাঁকে দেখে সেখানে নানা উপহাস শুরু করল। কেউবা তাঁর চলার পথে কাঁটা দিয়ে রাখল। এমনকি নামাজরত অবস্থায় তাঁকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করা হলো। তিনি কিন্তু সব অপমান নীরবে সহ্য করে ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন। হযরতের প্রচারিত ধর্ম মতে সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা:)। পুরুষদের ভেতর প্রথম ঈমান আনেন হযরত আলী (রা:)।
কোরাইশরা শুধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর সাহাবাদের উপরও অত্যাচার শুরু করল। এমতাবস্থায় মদিনা থেকে কিছু লোক এসে তাঁকে মদিনায় হিজরতের আহবান জানালে তিনি তাতে সানন্দে রাজি হলেন। এরপর তিনি তাঁর ভক্তদের (সাহাবা) একে একে মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অল্প ক’জন সাহাবা থেকে গেলেন তাঁর এর সফর সঙ্গী হতে। কোরাইশরা যখন দেখল তাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন তারা তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। এ জন্য তারা একরাতে হযরতের গৃহ ঘিরে ফেলল। উদ্দেশ্য ভোর হলেই হযরত যেই বাইরে আসবেন, অমনি তাঁকে খুন করবেন।
কিন্তু আল্লার পেয়ারা হাবীবকে খুন করা কী এতই সহজ! আল্লাহ জিবরাইল (আ:) এর মারফত এ ষড়যন্ত্রের কথা তাঁকে জানিয়ে দিলেন। ফলে ঐ রাতেই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রধান সাহাবা হযরত আবু বকর (রা:)-কে নিয়ে মদিনায় হিজরত করলেন। মদিনার লোকেরা খুব ভালো লোক ছিলেন। তাঁরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লার রাসূল বলে মেনে নিলেন।
হযরত মদিনায় যাওয়ার পর তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়তে থাকল। বিষয়টি মক্কার লোকেরা ভাল ভাবে নেয়নি। ফলে এক সময় তারা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। অনেক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে কোরাইশরা মদিনা আক্রমন করলো। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামমাত্র সৈন্য নিয়ে বদর নামক প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। আল্লার কুদরতে কোরাইশরা এ যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হল। পরবর্তী পর্যায়ে ওহুদের ময়দানেও আবার দু’পক্ষের লড়াই হয়। সে লড়াইয়ে চূড়ান্ত হারের মধ্য দিয়ে কোরাইশরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতই মহানুভব ছিলেন যে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি মক্কাবাসীর উপর চরম প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন মানবজাতির মুক্তিদূত হিসেবে, ত্রাণকর্তা হিসেবে। আর তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামের মূল কথাই ছিল- শান্তি। আমরা যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, সবাই জানি ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যাতে হানাহানির কোন স্থান নেই। জাতিভেদ প্রথা নেই। সব মুসলমান ভাই ভাই। ছোঁয়াছুয়ির কোন বালাই নেই। সবাই এক সঙ্গে বসে খানাপিনা করতে পারে। বংশে যে বড় সে বড় নয়, কাজে যে বড় সেই বড়। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা একশ পঁচিশ কোটিরও বেশি।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক