আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতি আজ স্মরণ করছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যাদের হারিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে। একই সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করছে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের স্বজনদের প্রতি, যারা দীর্ঘ ৫১ বছর ধরে বয়ে চলেছেন আপনজনকে নির্মমভাবে হারানোর মর্মন্তুদ বেদনা ও কষ্ট। এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা চেয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাতে এদেশে যথাযথভাবে বিকশিত না হয়।
২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত অপারেশন ক্লিনহার্ট এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি নিধনের জঘন্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করে। এরাতেই ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ১০জন শিক্ষককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। অর্থাৎ যুদ্ধের শুরু থেকেই হানাদার বাহিনী ধারাবাহিকভাবে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল, তার অগ্রভাগে দেশের মেধাবী সন্তানদের টার্গেট করেছিল। সর্বশেষ যৌথ বাহিনীর হাতে শোচনীয় পরাজয় বুঝতে পেরে বিজয়ের আগ মুহূর্তে তারা প্রতিহিংসার বারুদ ছাড়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপর। পাকিস্তানি শাসক ও হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের সহযোগিতায় বেছে বেছে হত্যা করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের। মূলত, পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা চেয়েছিল স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া দেশটিকে মেধায়-মননে পঙ্গু করতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এদেশের কিছু কুলাঙ্গার মুসলিম লীগের আজ্ঞাবহ জামায়াতে ইসলাম ও তৎকালনী ছাত্র সংঘের স্বাধীনতা বিরোধী ফোর্স আলবদর বাহিনীর ঘাতক সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর হাতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সেসব বিশ্বাসঘাতক নরাধমের অনেকেই পঁচাত্তর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত হয়েছে। একবিংশ শতকে এসে কেউ কেউ এমনকি মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে উড়িয়েছে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তানি দুঃশাসনের দিনগুলোতে বরেণ্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন জাতির বিবেক। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চালকও হতেন তাঁরা, এটি বুঝতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্বর হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নেয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিচারের দাবি ওঠে স্বাধীনতার পরপরই। বিচারকাজও চলছিল। কিন্তু ’৭৫ পরবর্তী শাসকরা বিচার দূরে থাক, খুনিদের প্রতিষ্ঠিত করেছে সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই বিচারকাজ শুরু করেন নির্বাচনী অঙ্গীকার সামনে রেখে। একাত্তরে যারা হত্যাযজ্ঞ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল, তাদের বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদুল ইসলাম, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলীর মতো ঘাতকদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে ঘৃণ্যতম। এসব হত্যাযজ্ঞে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব।
তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতা ও অপকর্ম আজও শেষ হয়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে দুষ্কৃতকারীরা তাঁর ভাস্কর্যে হামলা চালিয়েছিল। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী হেফাজত নামধারী ফতোয়াবাজরা বঙ্গবন্ধুসহ সব ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপতৎপরতা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে দেশে ও বিদেশে। বিজয়ের মাসে সমগ্র দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বজ্রশপথ নিতে হবে- যে কোন মূল্যে রুখে দিতে হবে দেশবিরোধী অপতৎপরতাকারীদের। উপড়ে ফেলতে হবে তাদের হিং¯্র বিষদাঁত। তা না হলে একাত্তরের মহান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে না কোনো দিন। আমরা আবারও বীর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তাঁদের আত্মত্যাগ স্বাধীনতার বিজয় ও জাতিগঠনে যে শক্তি যোগিয়েছিল তা আরো সঞ্জিবিত হোক।