বাংলাদেশ ভারত বহুমুখী সম্পর্কের মাত্রিকতা

6

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

দেশের বিজ্ঞমহলের ধারণা, মহান মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে ভারতের সাথে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের বহুমুখী সম্পর্কের গতিশীলতা নিবিড়তার উঁচুমাত্রিকতায় পৌঁছেছে। উত্তরোত্তর চলমান এই সম্পর্ক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, দুই দেশের সরকার প্রধান অতিসম্প্রতি পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী গ্রুপ অব টোয়েন্টি বা জি-২০ সম্মেলনে যোগদান প্রাক্কালে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় দেশের বিদ্যমান সম্পর্কে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুপ্রতিম উভয় দেশের সম্পর্ককে আরও জোরদারের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছেন। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুুষ্ঠিত বৈঠকে তিস্তা ও অমীমাংসিত ইস্যু আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ দেওয়াসহ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অসাধারণ অগ্রগতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন। এছাড়াও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে চলমান প্রচেষ্টা জোরদারে দুই দেশ একমত পোষণ করে। এ সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দ্রুততম প্রত্যাবাসনে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়। এছাড়াও দুই দেশের কৃষি গবেষণা খাতে সহযোগিতা, শিল্প-সাহিত্য ও দুই দেশের মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়।
উক্ত বৈঠকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি) রক্ষায় ভারতের দৃঢ় সমর্থন ও সাহায্যের অঙ্গীকার অক্ষুন্ন রাখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিতকরণে অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং তাঁকে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে নিমন্ত্রণের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। দুই দেশের মধ্যকার বৈঠকের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবেই বাংলাদেশকে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জি-টোয়েন্টিতে দু’ডজনেরও বেশি সদস্য ও আমন্ত্রিত দেশের নেতাদের উপস্থিতির মধ্যেও স্বাগতিক দেশ ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে। জি-২০ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জি- ২০ এর মুখ্য সমন্বয়ক ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘খুব কাছের বন্ধু ও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি- এটি আমলে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।’ বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলায় এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। আমাদের আলোচনায় কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
২৮ মে ২০২৩ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক জি-২০ প্রেসিডেন্সির আচরণবিধির অধীনে আয়োজিত ‘জি-২০ মেগা বিচ ক্লীন আপ’ শীর্ষক সমুদ্র সৈকত সাফাই কার্যক্রমে বাংলাদেশে নিযুক্ত সম্মানিত ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘ভারতের জি-২০ প্রেসিডেন্সি চলাকালে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের আমন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রহণ করা উভয় দেশের বিস্তৃত ও সুগভীর অংশীদারিত্বের প্রতিফলন। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হচ্ছে বহুমুখী এবং সেটা যৌথ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষাসহ সুবিস্তৃত নানা ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক আবাসস্থলের সংরক্ষণ-সুরক্ষার এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারসমূহের একটি স্বতঃস্ফূর্ত সম্প্রসারণ।’
এটি সর্বজনবিদিত যে, এই উপমহাদেশে ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতার অপসংস্কৃতির বিস্তার কলুষিত রাজনীতির অন্যতম বাহন হিসেবে এখনও চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে একশ্রেণির বর্ণচোরা-অর্বাচীন কথিত রাজনীতিক সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে দল-উপদলের পক্ষ থেকে বৈরী আবহ তৈরীতে ভারত বিরোধী প্রচারণাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। সচেতন মহলের কাছে সর্বক্ষেত্রে এটি অগ্রহণযোগ্য হলেও অনেকাংশে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-কুশিক্ষিত-অসচেতন ব্যক্তিবর্গের মনস্তত্ত্বে তার প্রভাব নেহায়েত কম নয়। এটি অবশ্যই স্মরণযোগ্য ১৯৭১ সালে ভারতের তৎকালীন মান্যবর প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকারের কূটনৈতিক-মানবিক সহায়তা, ভারতের সকল নাগরিকের অকুন্ঠ সমর্থন ব্যতিরেকে মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা দুরূহ ব্যাপার ছিল। মুক্তির এই আসাদন প্রেক্ষাপটে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নিরলস জ্ঞানাঙ্কুর পরিশ্রম বিশ্বইতিহাসের বর্ণালী অধ্যায়ে প্রজ্বলিত। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যক্ষ পক্ষাবলম্বন মুজিবনগর সরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অফুরন্ত অনুপ্রেরণায় শুধু ঋদ্ধ করেননি; পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে চৌকস অভিযান পরিচালনায় দক্ষ-প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনীর সকল রসদ যুগিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরঋণী করে রেখেছেন। ধারাবাহিকতায় অতীতে ভারতের প্রত্যেক সরকার ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দুই দেশের সুসম্পর্ক অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
মূলতঃ স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের সূচনাপাঠ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রæয়ারি কলকাতার ব্রিগেড় প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে।’ ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং সহযোগিতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। উক্ত সফরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী বন্ধুত্ব-শান্তি-সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু গঙ্গা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর সুষম পানি বন্টন ও ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে ১৬২টি ছিট মহল বিনিময়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার নাগরিকের জাতীয়তা নির্ধারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও শক্তিশালী ভূমিকার জন্য ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ফারক্কা বাঁধসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যেটির উপর ভিত্তি করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০১১ সালে সম্পাদিত হয় বাংলাদেশ-ভারত তিন বিঘা করিডোর চুক্তি। শেখ হাসিনা সরকারের অপরিমেয় কূটনৈতিক সাফল্যে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন অগ্রগতিতে বিশ্বস্বীকৃত বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা-মেধা-দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঊর্ধ্বে সমাসীন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের জয়লাভের ফলে বাংলাদশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে নবতর অধ্যায় রচিত হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। দুই দেশ দ্বিপক্ষীয়-আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বহু বিষয়ে মতৈক্য পোষণের প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবিরোধী এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। উল্লেখ্য সফরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখন্ডের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রানজিট সুবিধা, ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সম্মত, বাংলাদেশ কর্তৃক ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং ভারত কর্তৃক এক মিলিয়ন ডলার ঋণদান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মেলবন্ধন সুদৃঢ় হয়। ২০১৪ সালে শ্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ এবং শপথবাক্য পাঠের অনুষ্ঠানে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। ২০১৪ সালে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশে তার প্রথম আন্তর্জাতিক সফর করে সম্পর্ক উন্নয়নে ভিসা, বিদ্যুৎ, মৈত্রী এক্সপ্রেস, বাস চলাচলসহ ৬টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষর সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় হিসেবে বিবেচ্য। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধন দুই দেশের সম্পর্কের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ৩টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের সরকার প্রধানদের এক ভার্চুয়ালি বৈঠকে জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ ৭টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মাধ্যমেও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কে উঁচুমাত্রিকতার সেতুবন্ধন নির্মিত হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এই সফরটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্ব-তাৎপর্যপূর্ণ। সফরকালীন সময় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যু, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানিবন্টন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্বাক্ষরিত হয় সাতটি সমঝোতা স্মারক। সর্বশেষ বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ডলার সংকটকালীন সময়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন সহজ করতে এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিকল্প মুদ্রা চালুর উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে রুপিতে লেনদেনের যুগে প্রবেশ করে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত।
১৮ মার্চ ২০২৩ ভারত-বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনন্য মাইলফলক হিসেবে খ্যাত ‘ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। ভাতৃপ্রতীম প্রতিবেশি রাষ্ট্র। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ, ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক সেতু বন্ধন দুদেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করেছে। আমরা কৃতজ্ঞ যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণ অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। ১ কোটি বাঙালি শরণার্থীদের স্থান দেওয়া, তাদের খাবার-চিকিৎসার ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া এসব আমরা ভারতের কাছ থেকে পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীবাহিনীর অভিযানে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবে রূপদান করেছি। দুদেশের মধ্যে যেসব সমস্যা একে একে আমরা সমাধান করেছি। ৩০ বছর মেয়াদী গঙা পানি চুক্তি করেছি। ভারতের সঙ্গে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যেসব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল- রেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে সড়ক যোগাযোগ সবই আমরা মুক্ত করেছি। ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারণ আমরা ঘটিয়েছি। আমরা উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে আমরা উন্নয়নে সহযোগিতা পাচ্ছি। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার করা, উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি।’
উভয় দেশে আসন্ন জাতীয়-লোকসভা নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ও ভোটারদের অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সচেতনতার নতুন চাষাবাদে দুই দেশের সরকারের স্থিতিশীলতা নিবিড় ভূমিকা রাখবে বলে সচেতন মহল মনে করেন। উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থে নিত্য নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ ধরনের সম্মেলন থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক বার্তা সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতি বিশেষ করে ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিমেয় টেকসই সম্পর্কের ইঙ্গিত প্রণিধানযোগ্য। উভয় দেশের গণতন্ত্র-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-মানবতা-ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা-নানামুখী সংকট উত্তরণে জোরদার কূটনৈতিক-রাজনৈতিক দৃঢ় মনোভাব-অনুপ্রেরণা নবতর মোড়কে উদ্ভাসিত হবে নিঃসন্দেহে তা দাবি করা মোটেও অমূলক নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধে পারস্পরিক সমঝোতা-আলাপ-আলোচনা অনবদ্য ভীত রচনার অবাধ সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-সীমান্ত সংঘাত-বিরোধ নিরসনে কার্যকর অভিপ্রায়ে উভয় দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দৃশ্যমান থাকুক- এটিই কাম্য।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি