আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২০খ্রিস্টাব্দে ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিশোর বয়স থেকে তিনি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, সহপাঠিদের অধিকার আদায়, দুর্যোগকালীন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় তাঁকে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিল। ছাত্রজীবনেই ১৯৪০ সালের গোড়ায় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় ছাত্রনেতার খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই শেখ মুজিব ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেছিলেন। শুরুতেই ওই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা থাকায়, শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হতে ১৫ মার্চ পর্যন্ত জেলখানায় ছিলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তিনি জেলখানা থেকেও ভাষার জন্য আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন, জেলখানায় অনশন করেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন, যা বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ মুজিব মওলানা ভাসানী ও ইয়ার মোহাম্মদ খানের সঙ্গে মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। তিনি ওই সংগঠনের পূর্ববাংলা ইউনিটের যুগ্ম সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় থেকেই শেখ মুজিব তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতির কার্যক্রম শুরু করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে আইয়ুব খানকে সমর্থন দেননি। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক বছর জেলে থাকতে হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৬৬ ছয় দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ। ওই ৬ দফায় পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল স্পষ্ট। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয় দফার জন্য আইয়ুব খান সরকার কর্তৃক নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল। আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গণআন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্যও হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত ১১ দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক লাহোরে ঘোষিত ছয় দফারই প্রতিফলন ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সাতটি মহিলা আসনসহ মোট ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক পাড়া ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের নির্দেশে সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি জাতির উপর অপারেশন সার্চ লাইট’ চালায়। ওই অপারেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী, কৃষক ও শ্রমিকসহ বহু সাধারণ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, যাকে ইতিহাসের বর্বর হত্যাকান্ড নামে আখ্যায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গেই বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন। তারপরও বাঙালি জাতি কতটা অকৃতজ্ঞ, ইতিহাসই তার কালের সাক্ষী হয়ে আছে। সেই ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যদিও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেদিন ছোট্ট শেখ রাসেলও ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর প্রায় ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এ নেতৃত্ব দেশকে আজ উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে নিয়ে গেছে, তবে সেইসাথে দুর্নীতির অভিযোগও দীর্ঘ হচ্ছে। অনেক নেতাদের কার্যকলাপে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে আদর্শহীন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে-এটি কেউ কামনা করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আস্থাশীল সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী নেতৃত্বের মূল্যায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে-এমনটি প্রত্যাশা সকলের।