প্রসঙ্গ : শিক্ষকের মর্যাদা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

14

এম. কামরুল হাসান চৌধুরী

জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে এই দিবসটি পালিত হলেও আন্তর্জাতিক ভাবে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে একযোগে পালন করা হয়। এই দিবসটি মূলত: শিকদের মান-মর্যাদা সম্মানের অধিকারের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
পৃথিবীর সকল ধর্মের দীক্ষার মাঝে শিক্ষকের মান – মর্যাদা নিহিত আছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে আামাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেন, তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব শিষ্টাচার শিখ। যাঁর কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর, তাঁকে সম্মান কর (আল মুহামুল আওসাত, হাদিস নং – ৬১৮৪)।
পিতামাতার পর শিক্ষকের মর্যাদা হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষক -শিক্ষার্থীর গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মাঝে গড়ে উঠুক শিক্ষার পরিবেশ। এতে সুশিক্ষিত জাতি গঠনে সহায়ক হবে। জাতির বিবেক বলে সমাদৃত শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে জাতির ভবিষ্যতে প্রজন্মের চরম নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে সনাতনী নীতি বাক্যগুলো মনে রাখে কে ? বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার চরম বাস্তবতায় আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হয়ে গেছেন বড় জোর বন্ধু, অথবা কারও জন্য হয়ে উঠেছেন চরম শত্রু। শিক্ষকের মর্যাদার চরম দৈন্যদশায় আক্রান্ত আজ জাতির বিবেক।
জাতীয় শিক্ষা নীতির রোষানলের বলি হয়েছে শিক্ষা গুরুর মর্যাদা, খর্ব হয়েছে শিক্ষকের শাসন ক্ষমতা। শিক্ষার্থীদেরকে নৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা দানের ক্ষেত্রে আজ অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষকের হারানো শাসন ক্ষমতা। তাই দেশে প্রতিনিয়ত মর্যাদাহানি ঘটছে শিক্ষকদের। কোথাও বখাটে শিক্ষার্থীদের হেনস্তার শিকার, আবার কোন ক্ষেত্রে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন শিক্ষক সমাজ। এমনকি প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে শিক্ষকের। শিক্ষক সমাজের এমন অসহায়ত্বের বলি হলেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। সম্প্রতি সাভারের আশুলিয়া হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু কর্তৃক প্রকাশ্য দিবালোকে খেলার মাঠে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মারার দৃশ্য এই ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি জঘন্যতম দৃষ্টান্তও বটে! এখানে শিক্ষকের অপরাধ ছিল শুধুমাত্র একটি। আর তা হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকারী বখাটে ছাত্রটিকে শাসন করার কারণে যদি একজন শিক্ষককে এই নির্মম পরিণতি বরণ করতে হয় তাহলে এই দায় কার! এই গর্হিত অপরাধের জন্য দোষী কি শুধুমাত্র বখাটে ছাত্রটি নাকি শিক্ষককের শাসন ক্ষমতা খর্বকারিরা! কিন্তু এর জবাব দেবে কে ?
এছাড়াও ইতিপূর্বে সারা দেশে একের পর এক লাঞ্ছিত হচ্ছেন শিক্ষক। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের চরম নির্যাতিত হতেও দেখা যায়। যেমন কিছুদিন পূর্বে ধর্ম অবমাননার অজুহাতে পূর্বে হৃদয় মন্ডল আক্রান্ত হয়েছেন উশৃঙ্খল ছাত্রদের দ্বারা। নড়াইলের মির্জাপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কে জুতার মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছে দুঃস্কৃতকারি ছাত্ররা। গত বছরের ৩০ নভেম্বর বখাটে ছাত্রদের অযৌক্তিক মানসিক চাাপ খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেন আকস্মিক ভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। বিগত দিনে আমরা কিংবা আমাদের পূর্বসূরিরা যখন নিয়মিত পড়ালেখা শিখে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, তখন তার মূলে ছিল বিদ্যালয়ের শ্রেণি শিক্ষকের শাসনের ভয়। বিশেষ করে শৃঙ্খলার রক্ষার দিক থেকে বিদ্যাপীঠের পিটি ও ধর্মীয় শিক্ষকের ভয়ে পরিপাটি হয়ে যথসময়ে উপস্থিত থাকতাম মাঠে প্রাতঃ সমাবেশ বা এসেম্বলি নামক নৈতিক দীক্ষা কর্মসূচিতে। এতে একটু হেরফের হলে শিক্ষকের বেতের মার কিংবা নানা শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে ছাত্রদের। শিক্ষা গুরুদের নৈতিক দীক্ষাদানের শাসন নিয়ে কোন আপত্তি ছিলনা তখনকার সময়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। মূলতঃ শিক্ষা গুরুর প্রতি অগাঢ় ভক্তিমূলক ভীতির কারণে তখনকার দিনে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকরা এসব শাসননীতি অবলীলায় মেনে নিতেন। শিক্ষকের প্রতি অধিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকার ফলে তখনকার দিনে ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে প্রেরণা যুগিয়েছে। সর্বযুগে এই সত্য চিরন্তন। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শিক্ষকের শাসন ক্ষমতা আজকালকার শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে গেছে একধরনের রূপকথা।
অপরদিকে কখনও রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, কখনও পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকদের হাতে শিক্ষকদের নিগৃহীত হতে দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারা কিংবা কোন অনাকাক্সিক্ষত কারণে শিক্ষকদের চরমভাবে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। এই ধরনের আরেকটি বর্বরোচিত ঘটনা বিগত সময়ে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই জঘন্য ঘটনাটি দেশের একজন আইনপ্রনেতার। রাজশাহী -১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী কর্তৃক গোদাগাড়ী রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে কিল ঘুষি মেরে ও হকিষ্টিক দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করার ঘটনা। যদিও এমন নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে বিগত ৭ জুলাই কিন্তু দেশের সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে গত ১৩ জুলাই অর্থাৎ ঘটনাটি সংগঠিত হওয়ার প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে উক্ত ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার হীন প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে জনসম্মুখে ঘটনাটি প্রকাশের এই দীর্ঘসূত্রতা হয়েছে! এতে সহজে বুঝা যায় যে, শিক্ষকদের নিরাপত্তা আজ সমাজের কোথায় দাঁড়িয়েছে। যদিও ইতিপূর্বে অধ্যক্ষ নির্যাতনের ঘটনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই তদন্ত কার্যক্রম কতদূর এগিয়ে যাচ্ছে তা বরাবরের মতো আজও রহস্যময়। ফটিকছড়ির শাহ্নগর উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের কথিত পরিচালনা কমিটির রোষানলে পড়ে অধ্যক্ষ মো: জাহাঙ্গীর আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যু বরণ করেন। এছাড়াও অতি সম্প্রতি একই উপজেলায় উত্তর ধর্মপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বখাটে ছাত্ররা রাতে বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো: রবিউল হোসেনকে হামলা করে শুধুমাত্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করার জন্য। এভাবে দেশের সর্বত্র ঘটে চলেছে শিক্ষক নির্যাতন।
বর্তমান ডিজিটাল যুগের তথাকথিত কিছু শিশু মনোবিজ্ঞানীদেরও চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন ঘটিয়ে তাঁদের গবেষণায় নতুন করে আবিস্কৃত হলো শিক্ষকের শারীরিক শাসনের কারণে নাকি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকৃতি ঘটে। তাই সরকারের নির্দেশনায় শ্রেণি কার্যক্রমে বেত নিষিদ্ধ হল। শিক্ষকের শাসন ক্ষমতা খর্ব হল। তবে, বর্তমান ডিজিটাল যুগে শিশু মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা যে, একেবারে অমূলক তাও কিন্তু নয়, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তা প্রযোজ্য হতে পারে। তাই বলে, আবার সবক্ষেত্রে সমভাবে হবে তাও কিন্তু নয়। আজ শিক্ষা গুরুর বেতের শাসন বিলুপ্ত, শিক্ষাদানের শাসন ক্ষমতা খর্ব, শিক্ষকের মর্যাদাহানি অহরহ। তাইতো অপমানের ভয়ে দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজ মহান শিক্ষকতার পেশায় এগিয়ে আসছে না। যাঁরা ইতিমধ্যে এসেছেন তাঁদের অনেকে মান মর্যাদা রক্ষার ভয় নিয়ে আছেন। দেশে ছাত্র ছাত্রীদের পরিক্ষা ছাড়াই চলে পাশের অটো প্রমোশন। আবার সীমিত সিলেবাসের পরিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পাশের হারও অতুলনীয়। শিক্ষিত বেকার হয়ে আছে অসংখ্য। বাংলাদেশের মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থাপনার চরম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা জরুরি। তাই বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষকদের শাসন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার জরুরি । এতে শৃঙ্খলাপূর্ণ জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
অপরদিকে বর্তমান সমাজে তথাকথিত শিক্ষক নামধারি কিছুহীন মানসিকতার লম্পট চরিত্রের অসভ্য কুলাঙ্গারদের থেকেও জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। সম্প্রতি নোয়াখালীতে কথিত শিক্ষক নামের ঘৃণ্যতম আব্দুর রহিম রণি কর্তৃক একজন ছাত্রীকে জঘন্যতম পাশবিক নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যে কোনো শিক্ষার মাঝে শিক্ষকের স্বভাবগত আছরণ থেকে শিক্ষার্থীরা শারীরিক মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করে না, সেখানে কখনো সুশিক্ষার পরিবেশ সুনিশ্চিত হয় না।
সর্বোপরি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা, ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত রাজনীতি চর্চা সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ করা এবং কিশোর গ্যাংয়ের মারাত্মক ছোবল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শাসন ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্তত: মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে বেতের শাসন চালু রাখতে হবে। অবাধ্য, অমনোযোগী ও বখাটে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ শাস্তির বিধান রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করা জরুরি। এছাড়াও শিক্ষা বান্ধব সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করে প্রশাসনিক মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মেধা ও মননের উপযোগী শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সুনিশ্চিত হবে। এতে জাতির মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি সাধনে সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করি।
শিক্ষাগুরুর প্রতি একজন আদর্শিক ছাত্রের অসাধারণ শিষ্টাচার জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের সকল শিক্ষার্থীর জন্য যুগ-যুগান্তরে প্রেরণা যুগিয়ে সুশিক্ষিত জাতি গঠনে সহায়ক বলে আশাবাদী।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজকর্মী