প্রসঙ্গ : নারীর প্রতি সহিংসতা

6

এমরান চৌধুরী

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর আমরা ইতিমধ্যে পার করে এসেছি। সরকারি বেসরকারি নানাবিধ পদক্ষেপের ফলে নারীরা আজ প্রায় সবদিক থেকেই এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা, স্বাস্হ্য, অর্থনীতি, অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতায় নারীরা দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখলেও নারীর প্রতি সহিংসতা এতটুকু কমেনি, বরং বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। যদিও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী ক্যাম্পেইন, প্রতিবাদ, সমাবেশ, গোলটেবিল বৈঠক, টক শো, মানববন্ধন কর্মসূচি ইত্যাদি পালিত হয়ে আসছে। তবু একটি বিশেষ শক্তিধর গোষ্ঠী কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত আছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্হার পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতা শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ১০১৮ জন নারী, একই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৭৯ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩১ জনকে। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের সংখ্যা যথাক্রমে ৬৪৩, ২০৫ ও ৩০ জন। উপর্যুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ধর্ষণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
যে কারণে হোক যেভাবে হোক নারীর প্রতি সহিংসতা বা ধর্ষণ যে হারে বাড়ছে তা যদি মহামারিরূপে আবির্ভূত হয় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মেয়েদের ধর্ষণের শিকার হতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন ধর্ষকদের হাত থেকে শিশু হতে বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে নির্যাতিত শিশু-নারীকে। এসব নরকের কীট বীর পুরুষরা ধর্ষণের পূর্বে একটুও ভেবে দেখে না যে তাদের ঘরেও শিশু আছে, মা -বোন আছে, তাদের ওপরও তো এরকম অমানবিক ঘটনা ঘটতে পারে?
আজকাল পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে দু’চারটা ধর্ষণের খবর। বাস স্টপেজে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপসনালয় এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ধর্ষণ ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে না নারী ও শিশু। ধর্ষকদের বয়স ও শ্রেণি বিচার করলে আমাদের কেন জানি মনে হয় আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াত-এর যুগে ফিরে যাচ্ছি। বাপের বয়সী দানবের সাথে অংশ নিচ্ছে ১৩/১৪ বছরের শিশু। এই যদি হয় আজকের সমাজ চিত্র তাহলে পরিবার, সমাজ কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার কোনো না কোনোখানে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে মনে করা অস্বাভাবিক নয়।
একটা কথা স্পষ্ট যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানির আশংকার পরও মানুষের ভেতর দয়া-মায়া, শুভবোধ কাজ করছে না। বিষয়টি পরিবার ও সমাজের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এভাবে শিশু ও নারী নির্যাতনের শিকার হতে থাকায় অভিভাবকমাত্রই তাঁদের পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। আর এ নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অভিভাবকদের মনে যদি এ আশংকাবোধ জেগে ওঠে যে, ঘরে -বাইরে, স্কুলে-মাদ্রাসায়, চলন্ত ট্রেনে-বাসে যাওয়া-আসার পথে কোথাও তাঁদের পরিবারের শিশু ও নারীরা নিরাপদ নয়, যে কোনো স্হানে তারা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন তখন তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত না হয়ে পারে না। অন্যদিকে শিশুদের বাইরে পাঠিয়ে তাঁরা যদি নিশ্চিন্ত হতে না পারেন তবে তার প্রভাব পড়বে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে। এভাবে পরিবার ও সমাজে অস্হিরতা বাড়বে। এ ব্যাপারে শিশু অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মতে,ধর্ষণ মহামারীতে রূপ নেয়ার আগেই সব দিক থেকে প্রতিকার-প্রতিরোধের কাজ শুরু করা জরুরি।
শিশুদের প্রতি যে হারে সহিংসতা ও হিংস্রতা বাড়ছে তার প্রতিরোধে দাবি উঠেছিল ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ করার। সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদÐ করার পরও ধর্ষকদের এই জঘন্যতম কাজ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। তাহলে ফলটা দাঁড়াল এই যে, বিপথগামী ব্যক্তি মৃত্যুকেও কোনো পরোয়া করছে না। এই যদি হয় অবস্হা তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ ছাড়া এই অমানবিকতার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়। ধর্ষণের মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে পরিবারকে সবার আগে ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ ধর্ষকতো কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। শিশু ও নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন গুরুত্ব দিতে হবে পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে উড়তি বয়সী ছেলেটি বখাটে হয়ে উঠছে কিনা! কিংবা স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরছে কিনা? আমাদের মনে রাখতে হবে ছেলেমেয়েদের ভরনপোষণ করলেই মা-বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তার মনোজগত কীভাবে বিকশিত হচ্ছে কিংবা ছেলেমেয়েরা কাদের সাথে মিশছে তার প্রতিও নজর রাখা জরুরি। কারণ আপনার ছেলেমেয়েদের সুনামের জন্য আপনার বুক যেমন গর্বে স্ফীত হবে, তেমনি দুর্নামে আগে মাথা কাটা যাবে আপনারই।
ধর্ষণ তথা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিলেই হবে না, নতুন করে ধর্ষক সৃষ্টি যাতে না হয় কিংবা এ জাতীয় জঘন্য কাজে কেউ যাতে প্রবৃত্ত হতে সাহস না করে এজন্য ধর্ষক ও ধর্ষকের পরিবারকে সামাজিকভাবে এক ঘরে করতে হবে। তাঁদের ছেলেমেয়ের বিয়ে কিংবা যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান পাড়া-প্রতিবেশি একজোট হয়ে বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বেশিরভাগ ধর্ষণ ঘটনার পর ধর্ষককে বাঁচাতে সন্ত্রাসী -মাস্তান কিংবা প্রশাসনের অসাধু লোকজন কিংবা অর্থবিত্তের মালিক কিংবা গডফাদারদের কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন। ধর্ষকদের সঙ্গে এসব তদবির পার্টির লোকজনদের ধর্ষণ-কাজে সহযোগি হিসেবে বিচারের ব্যবস্হা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নীতি ও নৈতিকতার স্বার্থে কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে তিনি নিরাপরাধ প্রমাণিত না হওয়া অবধি তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। মা-বাবাকে তাঁদের কন্যা সন্তানদের চোখে চোখে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বাস নামক শব্দটাকে পুরোপুরি পরিহার করে নিজের ভার নিজেকেই নিতে হবে। বলাতো যায় না কখন কোন পুরুষের ওপর শয়তান সওয়ার হয়, আর সে শয়তানের কবলে আপনার নিষ্পাপটি শিশুটি যাতে না পড়ে তার জন্যে আপনি ছাড়া ভালো রক্ষাকবচ আর কেউ হতে পারে না? তবে ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপকর্ম থেকে আমাদের আগামী প্রজন্ম-মায়ের জাতকে বাঁচাতে প্রয়োজন প্রচলিত আইনের আমূল সংস্কার এবং সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে অপরাধীর সাজা নিশ্চিতকরণ। শুধু সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদÐ বিধান করে তাতে প্রশান্তি লাভ কিংবা ধর্ষণের হার হ্রাস পাবে এ আশা করা খুব একটা ফল দেবে বলে মনে হয় না। একমাত্র দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া এবং সামাজিক প্রতিরোধই এই অপকর্ম থেকে দেশ ও সমাজকে কিছুটা স্বস্হি দেবে বলে আমরা আশা করতে পারি। আগামী ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক নারী সহিংসতা প্রতিরোধ পক্ষে সবার প্রত্যাশা হোক এটাই।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক