মনিরুল ইসলাম মুন্না
সামাল দেওয়া যাচ্ছে না জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির জোয়ার। বাজার এতটাই গরম, তবুও অজানা কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো শীতনিদ্রায়। চট্টগ্রামে বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই বাস্তবমুখী উদ্যোগ। উল্টো বাজারদর নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা শরীরে কাঁটা দেওয়ার মতো। জিনিসপত্রের দামের লাগাম সরকার এখনই নিয়ন্ত্রণে না নিলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্রেতার ওপর আরও চেপে বসতে পারে বলে মনে করেন সাধারণ ক্রেতা ও সচেতন মহল। সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্ন, বাজার তদারকি ঠিকমত হচ্ছে তো? এরই মধ্যে একনেকের এক সভায় বাজার তদারকিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে বাজার তদারকি নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এত বাড়ানো ঠিক হয়নি। ধাপে ধাপে তেলের দাম বাড়ালে বাজারে বড় প্রভাব পড়ত না। পরিবহন ভাড়া বাড়ার কারণে এখন কিছু ব্যবসায়ী নিজের মতো করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলছে না।
তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে দ্রব্যমূল্য এমনভাবে ছুটছে যেন থামার নাম নেই। নিত্যপণ্যে ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ কত মুনাফা করতে পারবেন- সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি সরকার। এ সুযোগে ভোক্তার কাছ থেকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছেন। প্রতিদিন বাড়ছে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম। ফলে আরও কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জনজীবন।
যা বলছেন ব্যবসায়ী নেতারা
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি ছালামত আলী বলেন, ভাড়া নির্ধারিত না হওয়ায় পণ্যবাহী পরিবহনগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বলে আসছেন, পণ্য পরিবহনে কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করতে। তখন নির্দিষ্ট ভাড়ার বেশি আদায় করা যাবে না। তবে সরকার সেই পরামর্শ কানে তোলেনি। তিনি আরও বলেন, ডলারের অস্থিরতাও পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। দেশের ইতিহাসে ডলারের দাম কখনোই এত বাড়েনি। কেন এই অস্থিরতা, তা অনুসন্ধান করা জরুরি। নইলে দেশকে ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে।
দামে লাগাম নেই
দাম বাড়ার তালিকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন পণ্য। এত দিন দুই কেজির প্যাকেট আটা ১০০ টাকায় কেনা যেত। এখন দাম আরও ১০ টাকা বেড়েছে। খোলা আটার দামও পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া চলতি সপ্তাহ থেকে বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রির প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন ব্যবসীয়ারা। তবে এখনও নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশিতে চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১১০-১২০ টাকা দামে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাজারে পৌঁছায়নি সরকার নির্ধারিত দামের চিনি। যদিও গত সোমবার (২৪ অক্টোবর) ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মঙ্গলবার থেকে সরকার নির্ধারিত দাম, অর্থাৎ প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকায় বিক্রি করা হবে। সেসময় বাজারে চিনির সংকট থাকবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা। তবে এরপর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও বাজারে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। পাশাপাশি সপ্তাহের শেষ দিন বাজারে প্রতি কেজি আলু ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০ টাকা, রসুন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও আদা ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেলের দামও এখনও ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার।
কৃষিতে উৎপাদন খরচের বড় প্রভাব
ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধানসহ প্রতিটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে কৃষি অর্থনীতিতে দুই ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের ন্যায্য দাম পেতে হবে। আবার বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের খরচ বাড়বে।
কৃষক মো. ফারুক বলেন, আগে যে টাকা দিয়ে সার কিনতাম। তা এখন দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। আগে ৫০০ টাকায় জমিতে সেচ দেয়া গেলেও এখন ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে তা ১৫০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এভাবে কৃষিখাতে প্রতিটি জিনিসের খরচ বেড়েছে এখন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। যার মধ্যে রয়েছে- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, র্যাব ইত্যাদি। তারা বলছে, নজরদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
যা বলছেন ক্রেতা
গৃহিণী রহিমা আক্তার বলেন, মুদির দোকানে এক মাসের বাজার করতে গেলেই এখন ৫ হাজার টাকার বেশি চলে যাচ্ছে। আগে যেটা দুই হাজার টাকার মধ্যে সারতে পারতাম। যেভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তা বেশিদিন চললে আমাদের দেউলিয়া হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। মুদির দোকানের কথা বাদই দিলাম। সবজি কিংবা মাছের বাজারে কোনো ধরনের সংকট নেই। তবুও দাম কমছে না কেন? সুযোগ বুঝে অতি মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকিয়ে পকেট ফাঁকা করছেন। আমরা এর থেকে রেহাই পেতে চাই।
ক্যাব যা বলছেন
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপণ্যের বাজারদর বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের শাসনব্যবস্থায় এখন কোনো কিছুই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর ছাড়া হয় না। যদিও প্রশাসনিক কর্মবণ্টন ব্যবস্থায় সবকিছু উল্লেখ আছে, তারপরও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতেও বাজার তদারকির কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় রাখতে চেষ্টা চালানোর কথা বলেছেন। সামনের বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান দেশবাসীকে সঞ্চয়ী মানসিকতা গড়ে তোলার আহŸান জানিয়েছেন। ২০২৩ সাল বিশ্বের জন্য সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ একটা বছর বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ওই সময় দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। ফলে আমাদের এখন থেকেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্য সংরক্ষণের কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে বা প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। এছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারদর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ এবং একে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, সরকারের প্রধান শক্তি জনগণ। জনগণ ভালো থাকলে সরকারও ভালো থাকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন ও সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে বাজারে অস্থিরতার তাৎক্ষণিক সমাধান মিলবে।
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যা বলছে
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন যে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সর্বদা বাজার তদারকির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি বাজার আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছি। পূর্বের ন্যায় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা আইনানুগ আরও কঠোরভাবে বাজার তদারকিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ী ভাইদের প্রতি অনুরোধ, এ দেশ আমার আপনার সকলের। সুতরাং পণ্যের মূল্য অযাচিতভাবে বৃদ্ধি করে মানুষকে কষ্ট দিবেন না। অযাচিতভাবে কোনো ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করলে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
জেলা প্রশাসনের পদক্ষেপ
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বাজার তদারকির বিষয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। তা হল- আমরা এ পর্যন্ত দুইবার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করেছি। তারা আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যে, পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না। এমনকি কোনো পণ্য অতিমূল্যে বিক্রি করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবেন না বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরের টিম প্রতিদিন বাজার মনিটরিং করছে। বিশেষ করে খাতুনগঞ্জ এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিদিন তিনটা টিম বাজার তদারকিতে বের হচ্ছে। আইন অমান্যকারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ডের আওতায় আনা হচ্ছে। অনিয়মকারী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন সবসময় কঠোর অবস্থানে ছিল এবং থাকবে।