প্রতিবেশীর চোখে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন

4

অমল সরকার

মুক্তিযুদ্ধের সূত্রে ভারত ও বাংলাদেশ একে-অপরের ওঠাপড়ার সঙ্গী। এই বন্ধুত্বের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে। সম্পর্কটা এখন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প করার মতো। দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলায় টুইট সেই আন্তরিক সম্পর্কই ইঙ্গিত করে। খেয়াল রাখতে হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মাতৃভাষা গুজরাতি এবং ভারত সরকারের কাজের ভাষা হিন্দি ও ইংরিজি। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানেন, বাংলা ভাষার জন্য ওপারের বাঙালির মরণপন লড়াইয়ের কথা। আমার মতে, ‘ভারত পাশে আছে’, সরাসরি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতেও তিনি বাংলায় টুইট করেছেন।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুবাদে জানতে পারছি, আমাদের ঘনিষ্ঠ এই প্রতিবেশী দেশের ব্যস্ত মানুষটি হলেন পিটার হাস। তাঁর পরিচয় লিখে শব্দ খরচ করার অর্থ হয় না। তিনি বিগত কয়েক মাস যাবৎ নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় নেতা-মন্ত্রী-রাজনৈতিক দল-নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন। মনে হচ্ছে, যেন তিনিই বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার।
ঢাকার পত্র-পত্রিকায় দেখছি, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভারত সরকারের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কৌতূহল আছে এপারেও। বাংলাদেশে ভোট কেমন হবে, কারা জিতবে, কারা হারবে, সেটা সম্পূর্ণভাবে সে দেশের জনগণের বিচার-বিবেচনার বিষয়। দ্বিতীয় কোনও দেশের সেখানে নাক গলানোর কোনও সুযোগ থাকা অনুচিত। নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই। পাঁচ বছর পর দেশবাসীর সরকারের কাছ থেকে হিসাব-নিকাশ বুঝে নেওয়ার সুযোগ। সুস্থ গণতন্ত্রে ভোটের বাক্সে পরিবর্তন ও স্থিতাবস্থা, দুই মতই স্বাগত।
আমি ভারত সরকারের প্রতিনিধি কিংবা মুখমাত্র, কোনওটাই নই। তবে নয়া দিল্লির বর্তমান শাসকেরা ঢাকা সম্পর্কে তাঁদের অবস্থান বদল করেছেন, এমন কোনও খবর বা আভাস এপারে নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সদ্য অনুষ্ঠিত দিল্লি সফরের পর তো এই ব্যাপারে আর কারও সংশয় থাকার কথাই নয়। নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফারাক করেননি তিনি। আর অতিথিকে বাড়িতে ডেকে খাটো করার প্রশ্নই ওঠে না। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ ভারত আত্মার হৃদয়ের বাণী। এই সংস্কৃত বাগধারার অর্থ গোটা বিশ্ব আমার পরিবার। এটাই ছিল দিল্লির জি-২০’র প্রধান থিম। দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে এই প্রতিবেশীর গুরুত্ব আর পাঁচটা দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
একটু আগেই বলেছি, নির্বাচনের ব্যাপারে কোনও দেশের নাক গলানোর প্রশ্ন ওঠে না। তবে একথা সকলেই মানবেন, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কোনও দেশের নির্বাচনের ঘাত-প্রতিঘাত শুধুমাত্র সে দেশের ওঠাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।
চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় রেখেই প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশকে নিয়ে এপারের মানুষের কিছু পর্যবেক্ষণ এখানে পেশ করছি। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হল, দেশটির জন্মলগ্ন থেকে বহমান বিপরীতমুখী চোরাস্রোতটি আজও বিলীন হয়নি। যে নির্বাচনের ফলাফল পূর্ববঙ্গের মানুষকে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুরের ডাকে লুণ্ঠিত স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল, সেই নির্বাচনেও স্বশাসন, স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল প্রায় এক চতুর্থাংশ ভোটার। বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁরা দেশ ছেড়ে যায়নি বলেই স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে চার বছরের মাথায় শিশু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে খুন হতে হয় নিজেরই সেনার হাতে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশে দীর্ঘ সেনা শাসনে বাঙালি জাতিসত্তাকে ভুলিয়ে দিতে মৌলবাদের পরিকল্পিত উত্থান স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে থিতু হতে না দেওয়াই ছিল তাঁদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। শেখ মুজিবুরকে হত্যা ছিল একটি প্রগতিশীল রাজনীতিকে নিকেষ করার চেষ্টা। যে রাজনীতি জন্ম দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
জন্মসূত্রে আবদ্ধ এই দুই দেশ নিয়ে আলোচনায় প্রায়শই অপারের কিছু মানুষ খানিক অনুযোগের সুরে বলে থাকেন-বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। তাই এদেশের পক্ষে ভারতকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাছাড়া ভারত বৃহৎ প্রতিবেশী, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, এমন কথাও চাপা ক্ষোভ, অভিমানের সুরে বলে থাকেন তারা। আসলে বলার চেষ্টা করেন, বাংলাদেশ নিরুপায় হয়ে ভারতের দাদাগিরি সহ্য করছে। আমি বলব, এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। নিজের দেশকে খাটো করে দেখা।
ঘোর বাস্তব হল, পারস্পরিক নির্ভরতার প্রশ্নে উল্টোও সমান সত্যি। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট দেশ বলেই হয়তো সেদিকটা তেমন একটা আলোচনায় আসে না। ভারত-বাংলাদেশের ৪,১৫৬ কিলো মিটার সীমান্ত বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা। এর মধ্যে আছে ভারতের পাঁচটি রাজ্য আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের পূর্বপ্রান্তের পুরোটাই বাংলাদেশ। ফলে ভারতের পক্ষেও বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা অসম্ভব।
ভালবাসার গভীর টান থেকেই সীমান্তের এপারের মানুষ এটা প্রত্যক্ষ করে অসহায় বোধ করেছে যে, শেখ মুজিবুর হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশে চালকের আসনে থাকা ব্যক্তিরা দেশটিকে পাকিস্তান নির্দেশিত মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থেকেছেন। আর সেই সুযোগে দেশটি সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আঁতুরঘর হয়ে ওঠে, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে অস্থিরতা, নাশকতা চালিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্যপূরণে একটা সময় কলকাতাকে জঙ্গি ঘাঁটি বানানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই বাংলাদেশ এখন অতীত। তার উন্নয়নযাত্রাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আম-ভারতীয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে গেড়ে বসা নেতিবাচক ধারণাটিও বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আজ সাধারণ ভারতবাসী সমীহ, শ্রদ্ধা করে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল, এপারে যে মানুষেরা বাংলাদেশ এবং অনুপ্রবেশকে এক করে দেখতেন, তাঁরাও মত বদল করেছেন। আর তা শুধুই বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে নয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অর্জনও বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির স্বল্পকালীন রাষ্ট্রীয় সফরে যেভাবে বাংলাদেশের মানুষ, তাদের ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলেন, কূটনীতিতে তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই তাগিদ তিনি শুধুই ভূ-রাজনৈতিক কারণে করেননি, বাংলাদেশের অগ্রগতিকেও বিবেচনায় রেখেছেন।
এপারে গত বছর এপ্রিলে গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতের প্রাক্তন সেনা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্মানজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, ‘দেশের পশ্চিম সীমান্তে (পাকিস্তানের সঙ্গে) গোলমাল লেগেই থাকে। কিন্তু পূর্ব সীমান্তে তা নেই। কারণ, এই প্রান্তে আছে বন্ধু দেশ বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে রাজনাথ বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশও বলতে গেলে একপ্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছে।’ অথচ, ২০১৮ সালে ভারতের শাসক দল বিজেপির তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উঁইপোকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বাংলাদেশ তাদের অগ্রগতি এবং জঙ্গিবাদ বিরোধী কঠোর অবস্থান নিয়ে ভারত সরকার ও এ দেশের শাসক দলের মত বদল করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের একটি জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদ বাতায়নে এ দেশের হিন্দু জাতিয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর প্রাক্তন সম্পাদক সেশাদ্রি চারি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভারতের জন্য ভাল।’ বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক, নিরাপত্তা ও কৌশলগত উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ উদ্যোগ সফল করে তোলার জন্যও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেশাদ্রি চারির কথার প্রতিধ্বনী শোনা গিয়েছে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী শক্তিকে দমনে শেখ হাসিনার সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম রাজ্য তথা দেশের ওই প্রান্তে শাসক দল বিজেপির প্রধান মুখ এবং নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের কাছের মানুষ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রক কর্তৃক প্রচারিত প্রেস নোটে বলা হয়েছে, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিতকরণে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।’ আসলে বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলির দ্বারা আমরা প্রতিবেশীরাও নানাভাবে উপকৃত। ভারতের উত্তর-পূর্বের মানুষ এখন নিশ্চিন্তে ঘুমতে পারেন বাংলাদেশে ভারত বিরোধী নাশকতাবাদীরা নির্মূল হওয়ায়। দু-দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ায় দু-প্রান্তের মানুষই আর্থিকভাবে লাভবান। এই দুই প্রতিবেশী এখন একে অপরের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারছে। কিন্তু এই শান্তি, নিশ্চিন্তে ঘুম, পারস্পরিক আর্থিক সমৃদ্ধি কতদিন অব্যাহত থাকবে এই প্রশ্ন আমাদের আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদীদের আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠাটা গোটা উপমহাদেশের জন্যই চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আচমকাই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে বাইডেন প্রশাসন সে দেশের সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে নারীদের হিংস্র বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছে। তালিবানী মতাদর্শ, ভাবধানা মাথাচাড়া দিচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ফের মৌলবাদীদের প্রতি দুর্বল কোনও শক্তির হাতে পড়লে বিপদ গোটা উপমহাদেশের, মনে করে ভারতের মানুষ। মৌলবাদীদের দেশ, ধর্ম বলে কিছু হয় না। বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিলে ভারতে প্রতিস্পর্ধী মৌলবাদীরা আরও ফনা তুলবে। তাতে দুপারেই সংখ্যালঘুরা বেশি বিপন্নতার শিকার হবেন। এই কারণেও বাংলাদেশের ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে এপারের মানুষও ভাবিত।
লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, দ্য ওয়াল-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর এবং বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক