নিজস্ব প্রতিবেদক
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না বাঁশখালী আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের। এবার অস্ত্র হাতে নিয়ে মিছিল করে ভাইরাল হয়েছেন এই সংসদ সদস্য। সরকারের শেষ সময়ে সাংসদের এমন আচরণে বিব্রত আওয়ামী লীগ। মিছিলের সামনে প্রটোকলে অস্ত্রধারী পুলিশ থাকার পরেও কেন সংসদ সদস্য অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন তা তদন্তে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। গত সোমবার বিকালে বাঁশখালী উপজেলা সদরে অস্ত্র প্রদর্শনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ার পরেও সাংসদের অস্ত্র প্রদর্শনকে ঘিরে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। রাজশাহীর এক বিএনপি নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে এ মিছিলের আয়োজন করেছিল বাঁশখালী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, ‘বাঁশখালীর সংসদ সদস্য কেন অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন তা অনুসন্ধান করতে নির্দেশনা দিয়েছি। ডিএসবি ঘটনাটি অনুসন্ধান করে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিবে।’
অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে সাংসদের ফেসবুক পেজে অস্ত্র প্রদর্শনের কারণ জানিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে জনসভায় যদি বিএনপি নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠানোর মতো বক্তব্য দিতে পারেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিতে পারেন, তবে আমি বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে অগ্নিসন্ত্রাসকারী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে মিছিলে অংশ নিলে তাতে ক্ষতি কি? বিএনপি জামায়াতের নাশকতাকারীদের প্রতিরোধ করতে ভবিষ্যতেও জীবনবাজি রেখে মাঠে থাকতে পারলেই আমার রাজনীতির স্বার্থকতা।
মিছিলে এমপির পেছনে থাকা দুইজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘মিছিলটি উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে অল্পদূর যাওয়া মাত্র এমপি সাহেব ব্যাগ থেকে অস্ত্র বের করে হাতে নেন। এমপির হাতে থাকা অস্ত্রটি ছিল লাইসেন্স করা। লাইসেন্স করা অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধ নেই। নিরাপত্তার কারণে অস্ত্রটি তিনি হাতে নিয়েছেন। তবে মিছিলের সামনে নিরাপত্তা বিঘিœত হয় এমন কোনো পরিস্থিতি ছিল না। মিছিলটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে উপজেলা পরিষদের সামনে গিয়ে শেষ হয়।’
সাংসদ অস্ত্র হাতে মিছিল করছেন ৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও তার ফেসবুক পেজে নিজেই পোস্ট করেছেন। সেখানে এমপি অস্ত্র প্রদর্শন করছেন তা স্পষ্ট দেখা যায়। অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মিছিলের ব্যানার ধরে ছিলেন পৌরমেয়রসহ কয়েকজন চেয়ারম্যান। এগুতে থাকা মিছিলের ব্যানারের সামনেই ছিলেন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। হাঁটতে থাকা এমপি এক পর্যায়ে হঠাৎ পেছন দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দেন। মিছিলের পেছন থেকে কেউ একজন কালো রঙের একটি ব্যাগ এমপির হাতে দেন। ব্যাগটি এমপি খুলে পিস্তল নিজের হাতে নিয়ে কালো ব্যাগটি স্থানীয় ওলামা লীগ নেতা মৌলভী আকতারের হাতে দেন। এরপর জনসম্মুখে পিস্তলটি হাতে নিয়ে এমপি মিছিলে নেতৃত্ব দেন।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ এর ২৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি স্বীয় লাইসেন্সে এন্ট্রিকৃত অস্ত্র আত্মরক্ষার নিমিত্তে নিজে বহন/ ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্যের ভীতি/বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে এরূপভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না।
চট্টগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, মহান সংসদের সংসদ সদস্য যে কাজটি করেছেন সেটি সমালোচনা করার ভাষা নেই। দেশের বাকি ১৮ কোটি মানুষ যে কাজটি করলে অপরাধী হতেন তিনি সেই কাজটিই করেছেন। কিন্তু উনার বেলায় এটা কেন অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না? আইনের চোখে সবাই সমান। অস্ত্রটি যদি বৈধও হয় উনি সেটি প্রকাশ্যে শোডাউন কিংবা ত্রাসের জন্য প্রদর্শন করতে পারবেন না। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই সাংসদকেই অনুসরণ করবে দেশের তরুণরা। আমাদেরকে কিশোর গ্যাং বন্ধের কথা বলা হচ্ছে এভাবে অস্ত্র প্রদর্শনে কিশোররা কি বার্তা পেল। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রতি মানুষের যে অনীহা, অবিশ্বাসের পরেও ভোটারদের নির্বাচনমুখী করতে সরকারের যে কর্মতৎপরতা এতে গুড়েবালি দিলেন এই সংসদ সদস্য। স্পিকার, সরকারপ্রধান, পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে মনে করেছিলাম। কিন্তু কিছুই হয়নি। এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি আশা করছি তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিবে সরকার।’
২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে একের পর এক সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিতর্কিত কর্মকান্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলেই মনে করছে আওয়ামী লীগ। এই সাংসদের অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনায় বিব্রত দলটির নেতারা। দলের হাইকমান্ডকে লিখিতভাবে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাঁশখালী আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করে, প্রায় সময় কিছু কূটকৌশল অবলম্বন করেন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই কান্ড ঘটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেকে সহজসরল বোঝাতেই কিছু কল্পকাহিনী সাজান। এতে দল ও প্রধানমন্ত্রী বিব্রত হচ্ছেন সেটি তিনি মাথায় রাখেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে এরকম বহু ঘটনায় সমালোচিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ড কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পার পেয়ে যান। ব্যবস্থা না নেয়ায় সংগঠনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনো অস্ত্রবাজিতে বিশ্বাসী নয়। সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেই আওয়ামী লীগ এই জায়গায় এসেছে। মোস্তাফিজুর রহমান কি কারণে অস্ত্র ব্যবহার করেছেন তা আমরা খতিয়ে দেখবো। তিনি কোনো আশঙ্কা থেকে অস্ত্র প্রদর্শন করেছেন কিনা সেটিও জানবো।’
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের এমন কর্মকান্ডের বিষয়টি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে জানানো হবে। এরপর দল যেভাবে সিদ্ধান্ত দিবে সেভাবেই কাজ করবো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরেও আমরা অস্ত্র হাতে নিইনি। অস্ত্রনির্ভর রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না, আওয়ামী লীগ আদর্শনির্ভর রাজনীতি করে। অস্ত্রের রাজনীতিকে কখনো সমর্থন করেনি আওয়ামী লীগ। অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ভীতি দেখানো যায়, মনজয় করা যায় না। আওয়ামী লীগের প্রতিজন নেতাকর্মীকে আদর্শিকভাবে মনজয় করতে হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি করে মানুষের মনজয় করা যায় না। যে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্য করেছে তার বিচার দেশের প্রচলিত আইনে হবে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে চলবে না। বিএনপিই হত্যার রাজনীতি করে। এজন্যই দেশের মানুষ বিএনপিকে প্রতিহত করেছে।’