সুমন মজুমদার
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। তাই প্রত্যেক মানুষের শিক্ষিত হওয়া উচিত। একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে যেকোন মানুষ নিজেকে স্বশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও পাড়ি দিতে পারে, কর্মক্ষেত্রে বহু বেতনে উচ্চপদে সমাসীন হতে পারে কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধ ও সুশিক্ষা না থাকলে একসময় তার সব কিছুই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো নৈতিক মূল্যবোধ। আর নৈতিক মূল্যবোধ শুরু হয় পরিবার থেকে এবং নৈতিক শিক্ষা এর মূল ভিত্তি। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় নৈতিক মূল্যবোধ লালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে। প্রত্যেক মানুষের মানসিক বিকাশ গঠনে নৈতিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক সুশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবারই হল মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। প্রত্যেক পরিবারে বাবা-মা যেমন আদর্শ ধারন ও লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
শিশুর নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হলো পরিবার। আর পরিবার থেকেই নৈতিক মূল্যবোধ শিখালে প্রত্যেক সন্তান তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠবে। পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে যখন একজন শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন সে নিজেকে একা মনে করে, কিন্তু যখনই সে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের আদর- যত্ন পায়, তখন তার কাছে শিক্ষক প্রিয় হয়ে উঠে এবং সে নৈতিকগুণ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক মানুষের আচার-আচরণ তথা তার চরিত্র গঠনে তার নৈতিক শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। একজন মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে কীভাবে মিশবে, স্থান-কাল পাত্রভেদ অনুযায়ী কীভাবে আচরণ করবে, কাকে স্নেহ আর কাকে শ্রদ্ধা করবে, কাকে কীভাবে সমীহ করবে, কোন বিষয় কতটা ভক্তিভরে বা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারবে, তার অনেকটাই তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে অর্জিত আদর্শ ও মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে। পরিণত বয়সে একজন মানুষ তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে কী ভূমিকা রাখবে সেটাও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় বাল্যকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অর্জিত নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা। নৈতিক মুল্যবোধ মানুষের আচরণকে মার্জিত করে তুলে। তবে এই শিক্ষা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলা।আজকের তরুণরাই জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। তাদের বেড়ে ওঠা ও প্রাপ্ত শিক্ষার ওপর সংশিষ্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে। তাই তরুণ প্রজন্মের নীতি-নৈতিকতার উন্নয়নে তার পরিবার ও শিক্ষককে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হয়। কেননা চলমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন শিশু বা তরুণ প্রজন্ম নিজে নিজে বেড়ে উঠবে এমন ভাবাটা ঠিক নয়। সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হয়। এটা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় শিশুকে যত্ন ও পরিচর্যার। বিগত কয়েক দশক ধরে সেই যত্ন ও পরিচর্যার অভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় , নতুন প্রজন্ম ধাবিত হচ্ছে অধঃপতনের দিকে। তাই যদি এখন থেকেই পরিবার, শিক্ষক সমাজ সচেতন না হয় কিংবা নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে তরুণ প্রজন্মের ধ্বংস অনিবার্য, যা সমগ্র জাতির জন্য এক মহা সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে যা কারো কাম্য নয়। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার উন্নয়নে নিদিষ্ট পাঠ্যপুস্তক থাকলেও শিক্ষক চাইলে তাদের প্রত্যেকটা পিরিয়ডে নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু কিছু পরামর্শ দিতে পারে কেননা পিতামাতার পরে শিক্ষকরাই পারেন দেশকে একটা সুনাগরিক উপহার দিতে। তাই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে সকলেরই সুন্দর পরিবার, সমাজ ও সুখী সমৃদ্ধ উন্নত দেশ গঠনে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক