নির্বিচারে গাছ-পাহাড় নিধন

265

পাহাড়ে অবশিষ্ট থাকা মোথা ও গোড়াটি দেখলেই বোঝা যায় শতবর্ষী গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে বেশিদিন হয়নি। কোথাও বড়, কোথাও ছোট বা মাঝারি অনেক গাছই কেটে সাবাড় করা হয়েছে। কেটে ফেলা এসব গাছ পাচারে গাড়ি চলাচলের জন্য পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে সড়কও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের পুকুর থেকে পশ্চিমে পাহাড়ি বনাঞ্চলে প্রকাশ্যেই চলছে এমন পরিবেশ ধ্বংসের মহাযজ্ঞ। গত দুই মাসে কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি বনাঞ্চলের গাছ উজাড় করা হয়েছে। আর এসব গাছ পাচার হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক হয়ে মূলফটক দিয়েই; খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার অনুমতি নিয়ে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের পুকুর থেকে পশ্চিমের লালা ভান্ডারি আনসার ক্যাম্প পর্যন্ত কাটা গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। এ পথে পাহাড়ি বন ধরে এগিয়ে গেলে গাড়ি চলাচলের জন্য সদ্য তৈরি রাস্তা। এসব পাহাড়ি রাস্তায় শুধু চাঁদের গাড়ি চলে। গাছ পাচারে গাড়ি ব্যবহারের জন্যই ভেতরে পাহাড় কেটে করা হয়েছে অন্তত চারটি রাস্তা। প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত পাহাড় কেটে রাস্তা হয়েছে। ভেতরে চারদিকে সদ্য কাটা বিভিন্ন আকৃতির গাছের গোড়া দেখা যায়। এ পাহাড়টির সীতাকুন্ডের সাথে সংযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি স্থানটি ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৩০ জন শ্রমিক গাছ কাটা এবং পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত; তারা সবাই স্থানীয় বলে জানা যায়। আবার পাহাড়ে আগুন লাগিয়েও বন পরিস্কার করাও হয়েছে। প্রায় নিয়মিত বিকালে উঁচু পাহাড়ে থেকে পোড়া গাছের ছাই অনেকদূর পর্যন্ত ভেসে আসে। ভেতরের বিশাল অংশজুড়ে পাহাড় পোড়ানোর চিহ্নও দেখা গেছে। ওই সময় কর্মরত শ্রমিকদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন জহুরুল হক নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলগেট এলাকার স্থানীয় মো. হানিফ গাছ কাটা-বিক্রির কাজটি করেন। এ রাস্তা করতে প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় লেগেছে। খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকারও বেশি। এখান থেকে গাছ কেটে বের করার জন্য চাঁদের গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তা করা হয়েছে। রাস্তা করে কুমিরার সড়কের সঙ্গে সংযোগ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও জানান, নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেয়া মো. হানিফ এসব গাছ কেটে পাচার করে যাচ্ছেন। হানিফকে গত বছর মাদকবিরোধী অভিযানের সময় আটক করেছিল পুলিশ।
অভিযোগের বিষয়ে হানিফ পূর্বদেশকে বলেন, ‘এ জায়গার মালিক গ্রামবাসী নুরু, ইব্রাহিম, সৈয়দ আলী ও শফি। তাদের কাছ থেকে দুই মাস আগে আমি জায়গাগুলো কিনেছি। এখানে গাছ কেটে বের করার জন্য যতটুকু রাস্তা দরকার, ততটুকুই পাহাড় কেটেছি।’
পাহাড় কাটার অনুমোদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা করে দুটো ভাত খাওয়ার জন্য গাছ বিক্রি করি। তাই রাস্তার জন্য অল্প পাহাড় কাটতে হয়েছে। কিন্তু অনুমোদন নেয়া হয়নি।’
প্রায় প্রতিদিনই গাছ ভর্তি গাড়ি বের হতে দেখা যায় প্রধান ফটক দিয়ে। বন্ধের সময় আরও বেশি পরিমাণ গাড়ি বের হয়। এস্টেট শাখার অনুমতি ছাড়া কোন গাছ ভর্তি গাড়ি বের হয় না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) মো. বজল হক।
এদিকে কর্তনকৃত গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেব করতে খোদ এস্টেট শাখাই অনুমতি দিয়ে থাকে। ‘কর্তনকৃত গাছগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক রোপনকৃত নয়’ উল্লেখ করে এস্টেট শাখা প্রশাসক স্বাক্ষরিত চিঠিতে নিরাপত্তা দপ্তরকে গেট পাশের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্তনকৃত গাছের ক্রেতা স্থানীয় ফতেপুর বাসিন্দা মো. বজলের নামে অনুমতি নেয়া হয়। এরপর আবার ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাছ বের করার সময় বাড়ানো হয়।
এস্টেট শাখার প্রশাসক অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদ হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘এই পাহাড়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশও রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা এখনও পরিপূর্ণভাবে নির্ধারণ না হওয়ায় তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ একটি কমিটি আছে। ওই কমিটির সুপারিশে এসব গাছ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে বের করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এসব গাছ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোপণকৃত নয় বলে অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমরা তো শুধু গাছ বের করার অনুমতি দিয়ে থাকি, গাছ কাটার নয়। আর পাহাড় কাটা হচ্ছে, এসব তো আমরা জানি না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব গাছ মূলত ইট ভাটায় ব্যবহার করা হয়। হাটহাজারী উপজেলায় ৩০টির বেশি ইট ভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে ছোট-মাঝারি আকৃতির গাছ ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন, গাছ কাটায় নিয়োজিত এক শ্রমিক। ইট তৈরির মৌসুমে জ্বালানির চাহিদার বৃদ্ধিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাছ পাচারকারী চক্রটি। যদিও এসব গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেআইনি।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘গত মাসে বিপুল পরিমাণ গাছ জব্দ করা হয়েছে। মূলত আশপাশের পাহাড়, বাগান এসব গাছ কেটে ইট ভাটায় আনা হয়।’
বিপর্যয়ের মুখে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী : এদিকে গাছ কাটা এবং পাহাড়ি বন উজাড়ের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন পাহাড়ে অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে বিলুপ্তির পথে অনেক প্রজাতি। ২০০৮ সালে প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী ২৭ প্রজাতির প্রাণির বসবাস ছিল এসব পাহাড়ে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১৫ প্রজাতির প্রাণির অস্তিত্ব রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী এসএম আসমত পূর্বদেশকে বলেন, ‘জীববিজ্ঞান অনুষদের আশপাশেই যদি এ অবস্থা হয়, তবে তা ভয়ঙ্কর। একটা সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বন্যপ্রাণী থাকবে না। কারণ প্রাণিরা মাটিতে পা দিলেই বুঝে এ স্থান তাদের বসবাসের অনুকূল কিনা। এটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।’
সার্বিক বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরির্দশক মো. মাঈনুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিষয়ে অনুমোদন নিতে হবে। যদি অনুমোদন না থাকে তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’