ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ চোরাচালানিরা

48

তুষার দেব

ঘটনার পর তিন মাস গত হলেও কর্ণফুলীর শিকলবাহা মইজ্জারটেক এলাকায় প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে নয় কেজি স্বর্ণ জব্দের মামলায় জড়িত শীর্ষ চোরাচালানিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামির জবানবন্দিতে চোরাপথে বার্মা থেকে আনা ওই স্বর্ণের চালানের প্রেরক কক্সবাজারের শ্যামা জুয়েলার্সের মালিক বাপ্পু ধর এবং প্রাপক হাজারী লেনের বিশ্বকর্মা বুলিয়নের মালিক বিধান ধর ও মিয়া শপিং কমপ্লেক্সের দোতলার জয়রাম ট্রেডার্সের মালিক কৃষ্ণ কর্মকার বলে প্রকাশ পায়। এরপর থেকে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে নিজেরা আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে নিজেদের রক্ষায় গোপনে নানা তৎপরতা অব্যাহত রেখেখেন।
এত দিনেও ঘটনায় জড়িত শীর্ষ চোরাচালানিরা কেন গ্রেপ্তার হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে আলোচিত এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম জোনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রবিউল ইসলাম বুধবার সন্ধ্যায় পূর্বদেশকে বলেন, আসলে সার্বিক বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মামলার দু’জন আসামি আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বর্ণের চালান কোথা থেকে আনা হচ্ছে এবং কার কাছে নিয়ে যাচ্ছে তার বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। যাদের নাম এসেছে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট থানায় অনুসন্ধান স্লিপ পাঠিয়েছি। স্লিপের জবাবও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। অবশ্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা নৈতিক ও অনৈতিকভাবে নানা চেষ্টা-তদ্বিরে লিপ্ত রয়েছে। তাতে কোনো লাভ হবে না। যারা ঘটনার সাথে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
হাজারী লেনের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানান, শীর্ষ স্বর্ণ চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত বিধান ধর ও কৃষ্ণ কর্মকারের সাথে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছেন। তাছাড়া স্বর্ণ চোরাচালানের এই সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন সম্পর্কে পরস্পরের আত্মীয়। বিধান ধরের এক মামা এবং মামাতো বোনের জামাইও হাজারী লেনে স্বর্ণ ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। বৈধ জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অবৈধ কারবারের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ অভিযুক্ত বিধান ধর ও কৃষ্ণ কর্মকারকে খুঁজে না পেলেও তারা আড়ালে থেকে আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
পুলিশ জানায়, চলতি বছরের গত ১৬ জুন বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের মইজ্জারটেক এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি চালিয়ে ৯ কেজি ৫৭০ দশমিক ১২ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার ও পাত জব্দ করে পুলিশ। এ সময় চারজনকে আটক করা হয়। তারা হলেন টিপু ধর ওরফে অলক (২৩), নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ (৩৮), তার স্ত্রী জুলি ধর (৩৫) ও গীতা ধর (৩৮)। তারা সবাই বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের অনন্ত মহাজন বাড়ির বাসিন্দা। এ ঘটনায় শিকলবাহা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোবারক হোসেন বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। মামলাটি শুরুতে কর্ণফুলী থানা পুলিশ তদন্ত করে।
আসামিদের দুই দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এর মধ্যে আসামি নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ এবং টিপু ধর ওরফে অলক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, গত ১৫ জুন কক্সবাজারের আরএ শ্যামা জুয়েলার্সের কর্ণধার বাপ্পু ধর ফোন করে আগের মতো স্বর্ণ নিয়ে হাজারী লেনের বিশ্বকর্মা বুলিয়নের মালিক বিধান ধর ও কৃষ্ণ কর্মকারের কাছে স্বর্ণের চালান পৌঁছে দিতে বলেন। এর পর স্ত্রী জুলি ও কাকিমা গীতাকে নিয়ে কক্সবাজারে যান। লালদীঘির পাড়ে স্ত্রী ও কাকিমাকে রেখে বাপ্পুর দোকানে যান। তারা দু’জনের কাছে কাপড়ে মোড়ানো স্বর্ণ বুঝিয়ে দেন বাপ্পু ধর ও তার দোকানের ম্যানেজার গৌরাঙ্গ। এগুলো শীর্ষ স্বর্ণ চোরাকারবারি বাপ্পু ধর লোক মারফত মিয়ানমার থেকে এনেছেন বলে জানান। পরদিন ১৬ জুন ভোরে তারা দু’জন স্বর্ণগুলো জুলি এবং গীতার কাছে দিয়ে বাসে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। স্বর্ণগুলো জুলি ও গীতা পেটের দিকে শাড়ির নিচে বিশেষ কৌশলে বেঁধে নেয়া হয়। পথে মইজ্জারটেকে কর্ণফুলী থানা পুলিশের তল্লাশিতে স্বর্ণসহ ধরা পড়ে যান। আগেও এভাবে অন্তত আটটি চালান এনে হাজারী লেনের শীর্ষ স্বর্ণ চোরাকারবারি বিধান ধর ও কৃষ্ণ কর্মকারকে দিয়েছেন। সর্বশেষ চালানের জন্য বাপ্পু ধর তাদের দু’জনকে ২০ হাজার টাকা দেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। সাড়ে ৯ কেজিরও বেশি স্বর্ণের চালান জব্দ হওয়ার আলোচিত এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে নাম আসা শীর্ষ স্বর্ণ চোরাকারবারি বাপ্পু ধর, বিধান ধর, কৃষ্ণ কর্মকারসহ সহযোগীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি। দেশের বাজারে জুয়েলারি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে বিমানবন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইউএইসহ অন্যান্য দেশ থেকে চোরাপথে আসা স্বর্ণের বারের সাথে বার্মিজ স্বর্ণের বারের তফাৎ রয়েছে। প্রায়সময় বিমানবন্দরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চোরাপথে নিয়ে আসার পর জব্দ হওয়া স্বর্ণের বারগুলোর প্রতিটির ওজন থাকে ১০ তোলা বা ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম। কিন্তু সেই তুলনায় বার্মিজ স্বর্ণের বারগুলো অনেক বেশি ভারি। সাধারণত এগুলোর প্রতিটির ওজন ১৬৬ দশমিক ১১ গ্রাম। আকারেও এগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা স্বর্ণের বারের তুলনায় কিছুটা লম্বাটে। তবে ভিন্ন দেশ থেকে চোরাপথে এসব স্বর্ণ দেশে আসলেও সেগুলোর গন্তব্য একই জায়গায় বলে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা মনে করেন। চোরাপথে আসা এসব স্বর্ণের বার দেশের জুয়েলারির বাজারে আসে না। চোরাকারবারি চক্র নজরদারি সংস্থার চোখে ধুলো দেয়ার জন্য মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে স্বর্ণের চালান কক্সবাজারে নিয়ে আসার পর কারখানায় সেগুলো গলিয়ে ধরন পরিবর্তন করে। কর্ণফুলীতে জব্দকৃত স্বর্ণের চালানের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছুই করা হয়েছে।