মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর
কথা অতি সোজা, ছাত্ররা পড়ালিখা শিক্ষা করবে, গুরুগণ মন্ত্র দীক্ষা দিবেন তথা শিক্ষা দান করবেন। কিন্তু সেই জায়গায় এখন কেউ আর নাই, সবে যে যার স্থান বদল করেছে। ছাত্ররা অধ্যয়ন ফেলে বাৎস্যায়ন ধরেছে। এই যে বহুল আলোচিত সেঞ্চুরী মানিক, সে কোন পড়ালিখা কিংবা খেলাধুলায় সেঞ্চুরী করেনি। সে সেঞ্চুরী করেছিল দুই হাজার সালে কামসূত্রে, হেহেহেহে। সে কারণে বলছি, ছাত্ররা অধ্যয়ন ছেড়ে বাৎস্যায়ন ধরেছে। মানিক তো আবার ছাত্র, তার কথা না হয় বাদ দিলাম, ইদানিং ছাত্রীরাই নাকি সেঞ্চুরী করছেÑতবে সে আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে গুরুদের কথা কিছু বলি। আমরা জানি, গুরুগণ শিষ্যদের দীক্ষা দেন, মন্ত্র পাঠ করান তথা শিক্ষা দান করেন। উত্তম বিধান কিন্তু ইদানিং তাঁরা দীক্ষা না দিয়েধাক্কা দেন ও মন্ত্র ছেড়ে যন্ত্র ধরেছেন। তার এক উত্তম উদাহরণ, বছর চার-পাঁচ পূর্বে সীতাকুন্ডের এক মাদ্রাসায় শিক্ষক রহিম ছাত্র শিশু জাহেদকে এমন মাইর দিয়েছেলেন, ছাত্রকে সিধা সাতদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। তারপর মাত্র কিছুদিন আগের কথা, আনোয়ারাতে হেফজখানায় ছোট ছোট শিশুরা পবিত্র কোরান শিক্ষা করতে যায়, শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুগণের সেই শিশুদের প্রতি আচরণের পুরা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। মাটিতে ফেলে শিক্ষক কর্তৃক শিশুকে নির্যাতনের সেই নিষ্ঠুর দৃশ্য সার্চ দিলে ইউটিউবে এখনো দেখা যায়।
অতএব কেউ নিজের জায়গাতে আর নাই, সকলেই অন্য জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। শিষ্যরা অধ্যয়ন রেখে বাৎস্যায়ন ধরেছে, গুরুগণ মন্ত্র রেখে যন্ত ধরেছেন। ফলে চারিদিকে শুরু হয়েছে কেবলই যন্ত্রণা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক গুরু তথা মৌলানা ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিলেন। তিনি নাকি সেখানে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে ভালো করে ধোলাই করেছিলেন। ব্যস, ফিরার পথে রাতের আঁধারে একা পেয়ে তাঁকে কাদিয়ানী গুরুগণ তাঁর জিহব্বাটা কেটে নিলেন। তবে এর আগে পঞ্চগড়ে আহলে সুন্নতের গুরুগণ কাদিয়ানীদেরকে একহাত দেখিয়ে দিয়েছেন। ফলে গুরুগণ গুরুর জায়গায় নেই, শিষ্যগণ শিষ্যেদের জায়গায় নেই। কি তাজ্জব কথা-ইডেন কলেজে ছাত্রীরাই নাকি ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করে!তাহলে বলুন আল্লাহ্র দুনিয়া কি গজব হয়েযায় নাই? আবার কুষ্টিয়ার ইবিতে দেনলাম ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের উপর ছাত্রীনেত্রী অন্তরা-তাবাসসুমরা মিলে সারারাত স্টিমরোলার চালাল। আচ্ছা ভালোকথা, অন্তরা-তাবাসসুমরা নাকি ইবির ছাত্রী। কিন্তু পত্রিকায় তাদের যে ছবি দেখলাম তাতে তো মনে হলো তারা ছাত্রীর মা, হাহাহাহা! এজন্যে মনে হয় ইডেনের ছাত্রী নেত্রীরা দুঃখ করে বলেছে, ‘আমাদের ছোট বোনেরা বিয়ে করে একেকজন তিন-চার সন্তানের মা হয়ে গেছে, রাজনীতি করে আমরা কি পেলাম?’ সম্ভবত সেই বার্তা উপর লেভেলে গিয়ে বেশ আলোড়ন তুলেছে, তাই হয়ত বাঁধা গরু ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে যে যা খুশী করছে, উপর লেভেল চুপ রয়েছে, কারণ তাদেরও তো হৃদয় আছে।
উপর লেভেল ভেবে দেখল, এরাতো তাদের জন্যই কাজ করছে। ফলে তাদের লাভ তো দেখতে হবেই, তাদের মা হতে না পারার ত্যাগকে উপেক্ষা তো করা যায় না। ইডেনের সেই নেত্রীদের কথা নিশ্চয় উপর লেভেলের মনে দাগ কেটেছে। তাদের অন্তরে সেই নেত্রীদের জন্য রক্তক্ষরণ হয়েছে। থাক না, কি এসে যায় অমন দু-চারটা অপরাধে? তারা আমাদের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করছে, কাজেই তাদের জন্য সাত খুন মাফ-উপর মহলের হতে পারে এমনই চিন্তা। স্বাভাবিক, কেউ আমার জন্য একগলা নামলে আমার তো তারজন্য কোমর পরিমাণ হলেও নামতে হবে, নইলে শৃঙ্খলাই থাকে না। হতে পারে সেই চেতনা থেকে বাঁধাগরু ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং গরুও সেই সুযোগে বেড়া ভাঙতে শুরু করেছে, হেহেহেহে। উপর মহলের দয়ার শরীর, সেদিকে নজর দেয় না। উপর মহলের এত দয়া, তাহলে তা কত উপর? চলুন দেখি তবে সেটি, ‘এক অফিসে ফোন এল, এসিসটেন্ট ফোন ধরে বলল, হ্যালো। অপরপ্রান্ত হতে, আমি উপর থেকে বলছি, তোমাদের বসকে ফোন দাও। রিসিভার, আপনি কি ডিসি মহোদয়?কলার, আমি তার উপর থেকে বলছি। রিসিভার, তবে আপনি কি সচিব? কলার, না, আমি তার উপরে। রিসিভার, তাহলে আপনি কি মিনিস্টার? কলার, আমি তারও উপরে। রিসিভার, তাহলে আপনি রাষ্ট্রপতি? কলার, আমি তারও উপরে।
অতি বিস্ময়ের সাথে এবার রিসিভার, তাহলে আপনি কি প্রধানমন্ত্রী?কলার আরো গুরুগম্ভীরকণ্ঠে, না, আমি তারও উপরে।
রিসিভার, তাহলে আপনি কি জো বাইডেন?কলার, আমি তারও উপরে। রিসিভার, আপনি কি ঈশ^র?কলার, আমি তারওউপরে। রিসিভার, কিন্তু ঈশ্বরের উপর তো কেউনা। কলার, আমি সেই কেউ না।’ হাহাহাহা-এটাই ঠিক, যতই উপরে উঠবেন ততই হাতাই-তুকাই কিছুই পাবেন না। খালি অনুভব করবেন, কেবল হুকুম আসছে এবং সেই অনুযায়ী হুকুম তামিল হচ্ছে কিন্তু কোন মিল খুঁজে পাবেন না। কারণ উপরে কেউ না, কাজেই ঘটনা ঘটে, জনতা চটে, তদন্ত হয় বটে কিন্তু প্রমাণ হটে তাই কদিন পর তদন্ত যায় মিটে। অতএব উপরের আশীর্বাদে পুষ্ট হওয়া সন্তান হীনাদের মনোবেদনা ঘুচে গিয়েই গলায় উদ্ভূত হয় প্রচন্ড গর্জন। সেই গর্জনের প্রতাপ হতে নির্গত হয়, তোর হিম্মত কি করে হয় আমার হুকুম অমান্য করার? যেন বাঘের সামনে বিড়াল। অসহায় বিড়ালের তখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি দশা। হলের প্রক্টর-প্রভোস্টদেরও তখন সাধ্য থাকে না বাঘিনীর সম্মুখীন হওয়ার। সুতরাং উপরের বলে বলীয়ান সেসকল নেতা-নেত্রীগণ বাৎস্যায়ন না করে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করবেÑএই কথা চিন্তা করাটাই তো অপরাধ। সেই কারণে আমাদের গুরুগণও মন্ত্র ছেড়ে যন্ত্র ধরেছেন। নেতৃত্বের পরশে সিক্ত শিষ্যদের ক্ষমতার দাপট দেখে গুরুদেরও ক্ষমতার খায়েশ জাগে। তাই তাঁরা যুবলীগের সভাপতি পেতে ভিসি পদ কোরবানি করতে রাজি, হিহিহি।
আসলে উপর এক অসাধারণ ব্যাপার, উপরকে খোশ রাখতে পারলে মিটে যায় সব দোষ। মা হতে না পারার বেদনায় উপরও সমব্যথিত। ফলে সেই মহান ত্যাগ আমলে আসায় সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ সন্তানহীনা কুমারীগণ উপরের আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হয়। সন্তানের অভাব তাদের ঘুচে যায়, নতুন উদ্যমে ছাত্রীর খাতায় পুনঃ নাম লিখায়। তারপর কেবলই এগিয়ে চলা। আহা নেত্রীদের কি শক্তিÑসন্তান বিনা তারা সদা যৌবনা! তবে অভিনেত্রীদের সেই শক্তি নাই তাদের কেবল সন্তান চাই। অপু বিশ^াস, বুবলী, পরীমণি তার জ¦লন্ত উদাহরণ। তার চাইতেও সন্তান ধারণের আরো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে বিশ^খ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন, এলিজাবেথ টেলর, মেডোনা, এঞ্জেলিনা জুলি সহ আরো অনেকের। লিজ টেলর তো অনেক বয়স পর্যন্ত সন্তান ধারণ করেন। শুধু সন্তানধারণ করেই তাঁরা ক্ষান্ত থাকেন নি, অনেকে আরো সন্তান দত্তক পর্যন্ত নিয়েছিলেন, খালি ‘মা’ ডাকটা শোনার জন্য। আশ্চর্য মা ডাকে তাঁরা কি এমন মধু পেয়েছেন যা আমাদের ছাত্রনেত্রীরা পাচ্ছেন না?বলাহয় নারীত্বের পূর্ণত্ব আসে মাতৃত্বের মাধ্যমে। তবে ছাত্রীত্বের পূর্ণত্ব আসে নেতৃত্বের মাধ্যমে। ফলে নেতৃত্ব পেয়ে গেলে তাদের আর মাতৃত্বের দরকার হয় না, হাহাহাহা।
হতে পারে তাই ইডেনের নেত্রীরা যখন সন্তান-সংসারের কথা তুলল উপর থেকে তাদের সপক্ষে অঢেল ক্ষমতা ঢেলে দেওয়া হল। সেই অঢেলের ঢলে গলে গিয়ে তারা ঊর্ধ্ব বন্দনা শুরু করেদিল পলে পলে। ফলে ফাইল গায়েব তারা নায়েব, সবার উপর আছেন সায়েব। কিন্তু সেই সায়েব কে, তা কেউ জানে না। কি তার শক্তির উৎস, কোথায় তার অবস্থান কোন তথ্য নাই। শুধু জানি উপরে, কত উপরে, জানার কোন উপায় নাই। কোয়ান্টাম তত্তে¡ যেমন বলা হয় কণার নির্দিষ্ট কোন অবস্থান নাই, সেটি একই সময় সবজায়গায়Ñঠিক তেমন আমাদের কেউনা’ও একই সময় সব জায়গায় অবস্থান করেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোন অবস্থান নাই তাই তাঁর নামে কোন মামলাও নাই। কাজেই এই কেউনা’র পরশ পেতে সকলে উদগ্রীব। কেউনা’র শক্তির উৎস কোথায় কেউ জানে না। যেমন জানে না কণাবাদী বিশ্বে কণার শক্তির উৎস, তেমন জানে না বস্তবাদী বিশে^ অভিকর্ষ, মহাকর্ষের বিধান। অবশ্য শক্তি যে একটা আছে তা সবাই জানে তবে কাজ কেমনে করে তা বুঝেনা, হাহাহাহা। সুতরাং সেই শক্তির পরশ কে না চাইবে? যেমন আয়না ঘর, তার কোন অস্তিত্ব নাই কিন্তু কার্যক্রম আছে। কাজেই বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা। হরেক রকম পাগল দিয়া মিলাইছ মেলা, বাবা তোমার দরবারে——-।
সুতরাং সেই দরবারে সবাই আসবে। শিষ্যরা যেমন আসবে, গুরুরাও তেমন আসবে। দরবার সবারজন্য খোলা, কারো জন্য মানা নাই, শুধু যোগ্যতা দরকার। সেটা থাকলে নিতে পারবে, নইলে দিতে হবে। সারভাইভ্যাল ফর দ্য ফিটেস্ট, সাফল্য শুধু যোগ্যতমের জন্যেই। অতএব যোগ্যরাই টিকে থাকে, সেই টিকে থাকার লড়াইয়ে এখন শিষ্যদের পাশাপাশি গুরুরাও যোগ দিয়েছেন। এবং সেজন্য যেখানে যেভাবে তেলদিতে হয় সেভাবে তেল দিয়ে তাল মেরে যাচ্ছেন। তাই এখন গুরুরা মন্ত্র ছেড়ে স্তুতি ধরেছেন, দিনরাত শুধু নেতানেত্রীদের মোসাহেবিতে লিপ্ত হয়েছেন। আশ্চর্য শিক্ষকরা নেতাদের তোষামোদ করে চলেন। অথচ কথিত আছে খলিফা হারুনুর রশিদ সিংহাসন হতে নেমে এসে নিজ শিরস্ত্রাণ পেতে দিয়েছিলেন ওস্তাদজী হেঁটে আসার জন্য! সম্রাট আলমগীর নিজ পুত্রকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, পুত্র নিজ হাতে শিক্ষাগুরুর পা সাফ করে না দেয়ায়। আলেকজেন্ডার বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের জন্য আমার পিতার কাছে ঋণী, আর সেই জীবন সঠিকভাবে গড়তে পারার জন্য আমি এরিস্টেটলের কাছে ঋণী।’ বলাবাহুল্য এরিস্টেটল ছিলেন সম্রাট আলেকজেন্ডারের শিক্ষক। সেই শিক্ষকের আজ এই করুণ দশা।
আলোচনার এই পরিসরে কথাগুলো দেখছি বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। এত ভারি কথা টেনে নেওয়া বড়ই মুস্কিল। তাই চলুন কিঞ্চিৎ ভাসা পথেই চলি। ক্যাপশন দেখে মনেহয় আজকের প্রতিপাদ্য গুরুশিষ্য বিষয়ক প্রস্তাবনা কিন্তু আলোচনার পুরাটাই এসেছে গুরুশিষ্যা বাস্তবতা। এ এক আদি রঙ্গলীলা, গোটাই বাস্তবিক তাই অনুষঙ্গটা অতি প্রাসঙ্গিক। বলা দরকার গুরুশিষ্যা রসায়নে প্রবল বাৎস্যায়ন যোগ রয়েছে। উভয়ে নেতৃত্বের ছায়াতলে পৌঁছে গেলে গোপন আর কিছু থাকে না। দুজনেই নেতার চেলা, মেলামেশা খোলামেলা। সকল আফসোস লেবেঞ্চুস। সন্তানের হাহাকার নাই আর দরকার। গুরুশিষ্যা রসায়নে নিহিত বাৎস্যায়ন অসাধারণ, কাজেই আসবে সন্তান অবধারণ। ছাত্রী শিক্ষক রসায়ন প্রাগৈতিহাসিক পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক, স্বীকৃতি পেয়েছে সামাজিক। ফলে রাজনীতির কারণে সন্তানের দুর্ভিক্ষ-এই অপবাদ আর চলবে না।উপরের দুর্নাম থাকবে না, অনুশোচনা লাগবে না। যাবে পটে মন্তর, মিলবে দুইটি অন্তর। উঠবে লাটে অধ্যয়ন ঘটবে সদা বাৎস্যায়ন। থাকবে নাকো বেদনা, চলবে উপর বন্দনা। সবার মনে সান্ত¡না নতুনের সম্ভাবনা। দেখব খালি ক্যাম্পাস চারিদিকে প্যাম্পার্স। কোলে কোলে শিশু করছে শুধু হিসু।কন্যা-জায়া-জননী, পতি-পুত্র তরণী, থাকবে সুখে ঘরণী, হিহিহিহি, ধন্যবাদ আর নয় অপবাদ।
লেখক : কলামিস্ট