চট্টগ্রাম এখন ডেঙ্গুর প্রজনন স্থান বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রতিদিন মৃত্যু এবং আক্রান্তের খবর আসছে। হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের বাইরেও শত শত রোগী ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছে, অথচ সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে না। ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মধ্যে চসিকের মশক নিধন কার্যক্রম ও মশার ওষুধ নিয়ে আবারও নগরবাসীর মধ্যে মুখরোচক আলোচনা চলছে। আমরা জানি, চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে মশা নিধনে ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম চালাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে গত জুলাই থেকে চসিক কাউন্সিলরদের তত্ত¡াবধানে এ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বিভাগটি। তবে নগরবাসীর মধ্যে অনেকে এ মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, নগরের বিভিন্ন স্থানে ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো হলেও অনেক বাসা-বাড়ির আশপাশে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। চসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা যেখানে মানুষের আনাগোনা আছে, সেখানে লোক দেখানো ওষুধ ছিটিয়ে চলে আসছে। যদিও চসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, রুটিন অনুযায়ী নগরের সবখানেই ওষুধ ছিটানো হবে। এসব অসন্তোষের মধ্যে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে মশার ওষুধ নিয়ে। সম্প্রতি মশার ওষুধ নিয়ে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এতোদিন ফগার মেশিনে ওষুধ ছিটানো হলেও হঠাৎ মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য নালার পানিতে কালো তেল (লাইট ডিজেল ওয়েল) ব্যবহার করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। মূলত, পানির উপর তেলের আস্তরণে তৈরি হওয়া অক্সিজেন সংকটের কারণে মশার লার্ভা মারা যায়। একই কারণে মশার সাথে মারা যাচ্ছে পরিবেশের উপকারী কীটপতঙ্গ ও মাছ। এ কালো তেল বৃষ্টির পানির ¯্রােতে মিশছে কর্তফুলী নদীতে। কর্ণফুলীর দূষণের পাশাপাশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতেও। পানির সাথে মিশে যাওয়া এ কালোতেল দখল নিচ্ছে মাছের শরীর, যা খাবার হয়ে ঘুরেফিরে মানব শরীরেই ঢুকছে। এছাড়া সরাসরি নদীর পানি ব্যবহারকারীরা চর্মরোগের শিকার হচ্ছেন। বদ্ধ নালার পানিতে মশার লার্ভা মারতে লার্ভিসাইড কীটনাশক এবং উড়ন্ত (পূর্ণাঙ্গ) মশা মারতে ফগার মেশিনের সাহায্যে এডালটিসাইডের ধোঁয়া ছিটানো হয়। সাথে হারবাল কীটনাশক মশকুবান ও ন্যাপথার মিশ্রণও (যা এক ধরনের তেল) ব্যবহার করছে সংস্থাটি। এসবেও মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে চসিক। চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে চসিক ১৬ হাজার লিটার কালো তেল কিনেছে। যার দাম প্রায় ৩২ লাখ টাকা। এ তেল মশক নিধনে প্রতিটি ওয়ার্ডের নালা-নর্দমায় ছিটানো হচ্ছে। সংস্থাটি এতোদিন ফগার মেশিনে মশক নিধনের কার্যক্রম চালালেও এবার এ পরিবেশ বিধ্বংসী কালো তেল ব্যবহার করছে। তবে এ তেল আগেও ছিটানো হত। বিগত তিন দশক ধরে এ তেল ছিটানো হয়েছে বলে সূত্র জানায়। বর্তমান মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী এ কালোতেল ছিটানো বন্ধ করে ফগার মেশিনে ধোঁয়া ছিটিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এছাড়া তিনি প্রাকৃতিকভাবে হারবাল পদ্ধতিতে মশা নিধনেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর এসব উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি সৃজনশীল চিন্তা ও প্রকল্প বাদ দিয়ে আবারও কালোতেল ছিটানোর বিষয়টি নগরবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
নগরীর মশক নিধন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করা এ গবেষক মনে করছেন, কীটনাশকের কারণে দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। নতুবা এসব লোক দেখানো কর্মসূচি আর মশার কামড় দুটোই সমানতালে চলতে থাকবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘বদ্ধ পানিতে তেল ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের নালার গন্তব্য খাল হয়ে কর্ণফুলী। সেক্ষেত্রে নদীতে মাছের দুই ধরনের ক্ষতি করে। একেতো মাছ মারা যায়, দ্বিতীয়ত আক্রান্ত মাছ বাজারে চলে আসে। আমাদের বাজারগুলোতে মাছ তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিক্রি হয় না। তাই মাছে কালো তেলের উপস্থিতি পরিষ্কার করাটাও কঠিন। এক্ষেত্রে কালো তেল ব্যবহার না করে বিøচিং পাউডার ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে উত্তম হয়, নালাগুলো পানি পরিষ্কার রাখলে, প্রবাহমান পানি হলে এমনিতেও মশা জন্মায় না। কালো তেলে যে পরিবেশের ‘চরম’ ক্ষতি হচ্ছে সেটা তো নিশ্চিত। এটা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি।’ তবে চসিকের দাবি ‘মশা মারতে কালো তেলের কার্যকারিতা বেশি। পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হয়। কিন্তু মানুষ বাঁচাতে মশা মারতে হবে। তাই কালো তেল ব্যবহার করা হচ্ছে।’ আমরা মনে করি, জীব হিসেবে যে কোন প্রাণীর বাঁচার অধিকার আছে। সেটি আমাদের সংবিধান স্বীকৃত। আপনি নিজে বাঁচার জন্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করবেন তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা আশা করব সিটি কর্পোরেশন মশার ওষুধ ছিটানোর ক্ষেত্রে সকল জীবপ্রাণীর সুরক্ষাটি মাথায় রেখে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব ওষুধ ছিটানোর উদ্যোগ নেবে। বিশেষ করে চবি গবেষকদের পরামর্শকে আমলে নিয়ে ডেঙ্গুর আক্রমণ থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেবে চসিক-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।