ওয়াসিম আহমেদ
পথখাবার (স্ট্রিটফুড) মচমচে করতে নিজেদের অজান্তেই বিক্রেতারা ব্যবহার করছেন ক্ষতিকর সীসা। বিরিয়ানি থেকে মেজবানি খাবারে ব্যবহৃত গোলাপজলে গোলাপের কোনো উপস্থিতি নেই। নামিদামি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে পচা মাংস, ব্রান্ডের কারখানায় ভেজাল ঘি দিয়ে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি। ভেজাল মসলা ও জুস তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে উপকরণ ধ্বংস করেই থামেননি, কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে করেছেন মামলা।
অভিযান-মামলার সাথে খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মনিটরিং, খাদ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের সচেতন করতে সভা-সেমিনার আর সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকহারে সচেতনতা সৃষ্টিতে একহাতে লিফলেট অন্যহাতে মাইক নিয়ে বলে যাচ্ছেন খাবারকে নিরাপদ করে খেতে হবে, বিক্রি করতে হবে নিরাপদ খাবার। বলছি, পরিবহন আর জনবল সংকটের মধ্যে একজন অফিস সহায়ক ও একজন সহকারী নমুনা সংগ্রহকারীকে নিয়ে নিরাপদ খাবার নিশ্চিতে লড়াই করে যাওয়া চট্টগ্রাম জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলামের কথা। নগরের অদূরেই সীতাকুন্ড উপজেলার সলিমপুরে অবস্থান ‘দি কোয়ালিটি ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড এন্ড এগ্রো লিমিটেড’ এর। নামে কোয়ালিটি হলেও কাপড়ের রং দিয়ে তৈরি করছে জুস থেকে ইন্সট্যান্ট ড্রিংক পাউডার, গোলাপজল, ভেজাল মধুসহ আরও বেশ কয়েক ধরনের পানীয়। খবর পেয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা পুলিশকে সাথে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা।
প্রায় দেড়টন তৈরি খাবার ও উপকরণ জব্দসহ দুইজনকে আটক করা হয় সেই অভিযানে। পরে ডিবি পুলিশের এসআই তাজুল ইসলাম বাদী হয়ে সীতাকুন্ড মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন। সে মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কারখানাটির দুই কর্মচারী মো. শাহে নেওয়াজ ও মনির হোসেনসহ চার মালিক, মো. এনায়েত উল্লাহ, মো. তরিকুল ইসলাম, মো. তাজুল ইসলাম এবং কামরুল হুদা কাশেমকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় মালিকদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াও চলমান বলে জানিয়েছে থানা পুলিশ সূত্র।
জেলা নিরাপদ খাদ্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন বারকোড ফুড জংশনের রান্নাঘরে নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম চালায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ওই সময় নানান অনিয়ম ধরা পড়লে তা সংশোধন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। দুই মাস পার হওয়ার পরও সংশোধন না করায় ঢাকা থেকে কার্যালয়টির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এ সময় বারকোড ফুড জংশনকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একইদিনে ফুলকলি কারখানাকে অনুমোদনহীন ঘি, নি¤œমানের উপকরণ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারে লেভেল পরিবর্তন করে পুনরায় বাজারজাত করার অপরাধে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর আগেও ভেজাল মসলা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল মসলা ধ্বংস ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দেয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এসব বড় অভিযান ছাড়াও গেল জুলাই থেকে চলতি সেপ্টেম্বরে ৮০টি বেকারি ও রেস্তোরাঁ মনিটরিং করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে দিক-নিদের্শনা দেওয়া হয়। ৬টি কর্মশালা, ৭টি স্কুল সেমিনার, অংশীজনের সাথে ৩টি সভা, ২৫০ জন খাদ্য কর্মীকে প্রশিক্ষণ ছাড়াও পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৫শ। এর আগে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রোপলিটন কার্যালয় ১০০টি খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মনিটরিং করে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২টি কর্মাশালা, ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেমিনার, অংশীজনদের নিয়ে ৪টি সভা, ৬০০টি পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ এবং ৩০০ জন খাদ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনে কার্যালয়টি।
চট্টগ্রাম জেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এসব কর্মকান্ড চালিয়ে জনগণের মাঝে সাড়া ফেলা কার্যালয়টিতে সরেজমিনে গেলে যান ও জনবলের চরম সংকটের চিত্রের দেখা মেলে। নগরীর গোলপাহাড় মোড় এলাকায় একটি আবাসিক ভবনের তিন তলায় ভাড়া অফিসে নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়। নিজস্ব যানবাহন নেই কার্যালয়টির। তবুও নিজস্ব তাড়না ও দায়িত্ববোধ থেকে ছুটে চলার কথা জানিয়ে ফারহান ইসলাম পূর্বদেশকে জানান, ‘এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। কেননা যারা খাবার বিক্রি করছেন, তাদের মধ্যে খাবারের গুণগত মানের চেয়ে বাইরের চাকচিক্যের প্রতি নজর বেশি। তাছাড়া খাবারে ভেজাল দেওয়ার পর কোনো অপরাধবোধ দেখা যায় না। তাই, মানুষের বোধ জাগ্রত করতে প্রথমে সচেতনতা, দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও ইচ্ছেকৃতভাবে একই অপরাধ পুনরায় করলে আইন প্রয়োগ করা হয়। কি কি সংকট আছে সেদিকে না তাকিয়ে নিজের কাজটা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’