পূর্বদেশ ডেস্ক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা নিয়ে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে এখন বাদানুবাদ চলছে। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের আগে নয়াপল্টনে পুলিশের সাথে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে বিএনপি কর্মীর মৃত্যু এবং বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানের পর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং জাতিসংঘ অফিস বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। খবর বিবিসি।
বুধবার সকালে ঢাকার শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যাওয়ায় সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বিদেশি কূটনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা এবং মন্তব্যে সরকার কিছুটা ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও সরকার সেটি স্বীকার করছে না। অন্যদিকে বিরোধী দল দেখাতে চায় বিভিন্ন দেশ তাদের পক্ষে আছে।
ডিসেম্বর মাসের সাত তারিখ থেকে দশ তারিখের মধ্যে যা ঘটেছে সেগুলো ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলোকে জানিয়েছে সরকার। বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে বড় কিছু ঘটলে সেটা সবাইকে জানিয়ে রাখা হয়। এটা স্বাভাবিক একটি বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আমাদের দেশের যত হাইকমিশনার বা অ্যাম্বাসেডর বিদেশে কর্মরত আছে তাদের আমরা ব্রিফ নোট পাঠিয়েছি। এবং সেটারও কপি আমরা এখানেও দিয়েছি, বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বিএনপি গত সাতদিনে যে পরিমাণ বৈঠক তাদের সাথে করছে আমাদের উচিত আমাদের তথ্যটা জানিয়ে দেয়া কেউ জিজ্ঞেস করার আগেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ক‚টনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ নতুন কিছু নয়। অতীতেও বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কখনো কখনো এর প্রভাবও লক্ষ্য করা গেছে।
১৯৯৬ সালে কূটনীতিক চেষ্টা
১৯৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করতে থাকে তখন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। তখন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল। কমনওয়েলথের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফানও তখন ঢাকায় এসেছিলেন দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক আপোষ মীমাংসা করতে। কিন্তু তারপরেও কোনো লাভ হয়নি। বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা নির্বাচন করেছিল।
কিন্তু সেই নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে আরেকটি নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ রাস্তায় তীব্র আন্দোলন যেমন গড়ে তুলেছিল তেমনি কূটনীতিকদের চাপও তৈরি হয়েছিল। ফলে আরেকটি নির্বাচন না দিয়ে কোনো উপায় ছিলনা বিএনপিরও।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরে খালেদা জিয়া নির্বাচনের ফলাফল মানতে চাচ্ছিলেন না। পাঁচজন রাষ্ট্রদূত তার বাসায় গিয়ে তাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছিলেন। তখন তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, এরা বিদেশি এরা কী জানে?
২০০৭ সালে কূটনীতিক হস্তক্ষেপ
২০০৭ সালে বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচনের ১১দিন আগে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইয়াজউদ্দিন আহমদকে ইস্তাফা দিতে বাধ্য করেন সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি। এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা ছিল পর্দার আড়ালে এবং সামনে থেকে। এদের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এর সাথে আরো সম্পৃক্ত ছিল কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দিতেন।
এক তরফা নির্বাচন ঠেকাতে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘ প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান সতর্ক করে দেন যে বাংলাদেশে যদি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নানামুখী কূটনীতিক চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পথ তৈরি হয় এবং তার মাধ্যমে সেনা-সমর্থিত নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
২০১৩ সালে জাতিসংঘের বিশেষ দূত
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো – ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো রাজনৈতিক সমঝোতা করানোর জন্য ঢাকা সফর করেছিলেন। আওয়ামী লীগ তখন একতরফা সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপি তখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। তারানকো চেয়েছিলেন, দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের পাঁচই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে যায়। যদিও তখনও আওয়ামী লীগ সরকারের উপর বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের চাপ ছিল কিন্তু ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। সেজন্য শেষ পর্যন্ত অন্যসব চাপ আওয়ামী লীগ সরকার উপেক্ষা করতে পেরেছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শুধু ক‚টনীতিক চাপ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব তৈরি করা কঠিন।
রাজনীতির মাঠে একটি দল কতটা কৌশলী এবং রাস্তার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা কতটা রয়েছে সেটিও অনেক ভূমিকা রাখে।