পারভীন আকতার
প্রতিটি মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে চান। আর সেই কঠিন কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারলে তা পরখ করে স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তেমনি আমাদের দেশে সরকারী প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর জাতীয়ভাবে অর্জিত কাজের সুনাম স্বীকৃতি স্বরূপ রাজস্বখাতের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ হিসেবে অগ্রগণ্য করেন উপজেলা পর্যায় থেকে। এরপর জেলা, বিভাগ হয়ে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই চলে। বেসরকারি ভাবেও কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন কার্যক্রম চালু আছে যা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টভেদে আছে রকম ফের। কর্মক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেলে ফের দায়িত্ব, কর্তব্য ও প্রত্যাশা অনেকাংশে বেড়ে যায় তাও আমাদের মনে রাখতে হবে। এবার উল্লেখ করছি আমাদের ডিপার্টমেন্ট তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর (বিভাগ)কর্তৃক আয়োজিত শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রতিযোগিতার নামটি যা ‘জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক’ নামে পরিচিত এবং বর্তমানে এই কার্যক্রমটি বেশ জনপ্রিয়। এতে বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়ে থাকে। উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক -শিক্ষিকা,শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা, শ্রেষ্ঠ কাব শিক্ষক, সেরা বিদ্যালয়, শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি, শ্রেষ্ঠ সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, শ্রেষ্ঠ অফিস সহকারী, শ্রেষ্ঠ বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি (এসএমসি) ইত্যাদি। এর পরবর্তী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয় জেলা পর্যায় থেকে।
আমি শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হয়েছিলাম পদ ক্যাটাগরি বিভক্তির আগেই ২০১৮ সালে। পরে পদ বিন্যাসে আলাদা প্রধান ও সহকারী পদে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক শিক্ষিকা নির্বাচন করা হচ্ছে দেখে ভালই লাগল। দুই জন অন্ততঃ আরো বাড়ল কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার মতো। তবে কাব কার্যক্রমেও শিক্ষক ও শিক্ষিকা আলাদা শ্রেষ্ঠ করলে আমি মনে করি কাব কার্যক্রম আরো এগিয়ে যাবে বহুগুণে। এতে শিক্ষিকাগণও কাবিং কার্যক্রমে আরো এগিয়ে আসবেন। সাথে শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া শিক্ষক ও শিক্ষিকা নির্বাচন করা সমীচীন। ক্রীড়া হলো লেখাপড়ার আনন্দ প্রাণ। ক্রীড়া শিক্ষকগণ মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন কিন্তু তাঁদেরও কোন জাতীয় স্বীকৃতি নাই। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়া উচিত। শিক্ষকদের উৎসাহ দেয়া আমাদের ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। আশার কথা বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম নৈশপ্রহরী বিদ্যমান। তাঁরা ঘরবাড়ী ফেলে সারাবছর বিদ্যালয়ে তাঁদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে তাঁদের কোন ছুটিরও ব্যবস্থা নেই। এমন দিনরাত খেটে যাওয়া মানুষগুলোকেও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরানো উচিত। ‘শ্রেষ্ঠ নৈশপ্রহরী’ পদকটি পেলে তাঁদের কাজের প্রতি আরো নিষ্ঠা বাড়বে। উল্লেখিত বিষয়াদি ভেবে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ অনুরোধ রইল।
বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ দেয়া হয় কোন একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে একটা ক্রেস্ট আর সনদপত্র। আমাদের সময় কেবল ক্রেষ্ট দিয়েই দায় সারা পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। শ্রেষ্ঠ হওয়ার সনদপত্র প্রামাণ্য দলিলও দেয়া হয়নি। একেক সময় একেকটা প্রথা চালু হয়।এতে মনোক্ষুণœ হয়েছে অনেকেরই।বিজ্ঞ মহলে আলোচনা সাপেক্ষে জানা যায় যে তাঁরা শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কারে অবশ্যই কিছুটা হলেও আর্থিক সম্মানী থাকা আবশ্যক বলে মনে করেন। তাহলেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত সব পদের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ এবং কাজে আরো বেশি মনোযোগী হতেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারে যেখানে আর্থিক সম্মানী দেয়া হয় আর এটাও তো জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা তাহলে তা কেন কেবল একটি ক্রেস্ট আর সনদপত্রে মতো হালকা উপহারে শেষ হবে তা সচেতন নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের কাছে বিনয়চিত্তে জানতে চান। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। স্বয়ং রাষ্ট্রায়ত্ত দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব কাজে হরহামেশাই গাফলতি পরিলক্ষিত হয়। সম্মান যখন দেয়াই হচ্ছে তা মনে রাখার মতোই রাষ্ট্রের দেয়া উচিত। এবং বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণে অংশ হিসেবে বিগত সালেরসহ বর্তমানের সকল উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও অংশগ্রহণ জরুরি। শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতাটি যেন স্বচ্ছতার সাথে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাও কামনা করেন বিজ্ঞমহল।
আরেকটি বিষয় যা না বল্লেই নয় তা হলো প্রবীণ এবং অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের আমরা কেন জানি জাতীয় ভাবে মূল্যায়ন করতে খুবই অনীহা প্রকাশ করি। আজ বয়সে তরুণ চাকুরে ঊনষাট পেরুলেই তিনি হবেন অবসরপ্রাপ্ত। বৃদ্ধ বয়সে দেখেছি তাঁর কতই না আমরা অবহেলা করি। অথচ সেই সময়ে যদি জাতি গড়ার প্রবীণ কারিগরগণ যথাযথ ‘শ্রেষ্ঠ ও আজীবন সম্মাননা পদক’ সাথে যৎসামান্য সম্মানিসহ সম্মান মর্যাদা রাষ্ট্র থেকে পেতেন, আমার মনে হয় তাঁরা শান্তিতে এ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস গর্বে ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমাতেন। আমরা যেন কখনোই ভুলে না যাই আমাদের অগ্রজ শিক্ষক শিক্ষিকাগণ শিক্ষার উন্নয়নে তাঁদের অবদানের কথা। বিষয়গুলো জাতীয়ভাবে আলোচনা হওয়া অতীব জরুরী এবং এ বিষয়াবলী বিবেচনা সাপেক্ষে আগামীতে জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ তিনি এদেশের পরিস্থিতির আলোকে হয়তো তখন তা বলে গেছেন। কিন্তু এখনো আমরা সঠিকভাবে গুণীজনের কদর করতে জানি কি না তা নিয়ে বিজ্ঞ মহলে নানা কথা শোনা যায়। আমরা দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাইলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বকে ভালোবাসা ও কদর করা। কে, কখন আর কীভাবে তার স্বীকৃতি পাবে তা কেউ জানে না। কিন্তু নিজের পরিশ্রম ও সাধনার কাজের পরিতৃপ্তি পাওয়াই আসল স্বীকৃতি ও শান্তি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা পাবো পুণ্যের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। অহমিকা নয়; নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার সুযোগ আছে সমসময়। আসুন নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসা ও মায়া বাড়াই।
লেখক : শিক্ষক- কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম