সড়ক, রেল ও নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও উদ্বোধনের পর এবার চট্টগ্রাম নগরজুড়ে উড়াল পথের দ্বার উন্মোচন হল গতকাল মঙ্গলবার। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার গণভবন থেকে ভার্চুয়ালে যুক্ত হয়ে দীর্ঘ এ উড়াল সড়ক উদ্বোধন করেন। মাত্র ষোল দিনের ব্যবধানে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চ্যানেল উদ্বোধনের পর এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম নগরীর মাথার উপর নির্মিত দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করলেন। সেই সাথে পুরো নগরী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আওতায় চলে আসল। এ উড়াল সড়ক চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরেকটি মাইলফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ও বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রামের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছিল। নানা অভিধায় চট্টগ্রামের খ্যাতি ছড়ালেও প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রাম নানাভাবে অবহেলিত হয়ে আসছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে ঐতিহ্য চট্টগ্রামের ছিল তাও অনেকটা লোপ পেতে বসেছিল। ব্যবসায়ীদের চরম হতাশা যখন ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন বর্তমান সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। সেই থেকে চট্টগ্রামে একের পর এক চলছে চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন। এ উন্নয়নের পালকে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নগরীর টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটারের দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ও মুরাদপুর থেকে শুরু হওয়া বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারকে। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে শাহ আমানত সেতু থেকে আসা সড়ক ও জনপথ বিভাগের ছয় লেনের সড়ক। এতে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পাচ্ছে নগরবাসী। গতকাল উদ্বোধন হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসের কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও ১৪টি র্যাম্প নির্মাণের কাজ এখনও বাকি আছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ র্যাম্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এরপরই সড়কটি যান চলাচলে উন্মুক্ত করা হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে বহদ্দারহাট থেকেই পতেঙ্গা বিমানবন্দর পর্যন্ত অতিদ্রæত পৌঁছা সম্ভব হবে। কোনদিকে যানজট নামক দুর্ভোগে পড়তে হবে না। পাশাপাশি বিমানবন্দর, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও টানেল হয়ে কক্সবাজারের দিকে যাতায়াত করতে পারবে। সিডিএ কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাগর পাড় দিয়ে আউটার রিং রোড পতেঙ্গায় টানেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যাওয়ায় এবং ফৌজদারহাট থেকে বায়েজীদ বোস্তামী পর্যন্ত একটি বাইপাস নির্মিত হওয়ায় এখন পুরো নগরী রিং রোডের আওতায় চলে এলো। ফলে আন্তঃজেলা রুটের গাড়িগুলোর এখন আর শহরে প্রবেশ করতে হবে না। প্রাইভেট ও পণ্যবাহী গাড়ি প্রয়োজনে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মুরাদপুর বহদ্দারহাট হয়ে পার্বত্যজেলায় যেতে পারবে।
উল্লেখ্য যে, ৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকার প্রকল্পটি সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায় তা একনেকে অনুমোদন পেলেও গত অক্টোবরে এর সংশোধিত বাজেট বেড়ে ৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। নগরীর এসব সড়ক দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামের প্রতি দেশ ও বিদেশের বিনিয়োগ বাড়বে। তবে এসব নতুন সড়কের পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টি না দিলে এসব প্রকল্প থেকে শতভাগ সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন ট্রাফিক বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এক সময় শহরের ভেতরে যানজট হতো। এখন শহরের বাইরের জংশনগুলোতে যানজট বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যানজট থেকে মুক্তি নেই। এজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কে ধন্যবাদ জানাতে চাই, এ এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ের নাম চট্টল বীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে নামকরণ করায়। এ চট্টগ্রামের উন্নয়নসহ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিত আন্দোলনে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রামের প্রতি তার দরদ ও ভালোবাসার প্রতিদান হয়ত দেয়া যাবে না, তবে এ উড়াল সড়কের নামকরণ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে তা স্মরণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী গতকাল একইসাথে চট্টগ্রামের আরো ১৮টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরমধ্যে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার নামে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংরোড, জানে আলম দোভাস বাকলিয়া এক্সেস রোডও উদ্বোধন করেন। এসব সড়ক চট্টগ্রাম নগরীর অভ্যন্তরীণ যোগোযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখবে। তবে এ সড়ক সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে যতœশীল হতে হবে।