উষ্ণতা বেশি থাকতে পারে এবারের শীতে

23

তুষার দেব

সাগরে অবিরাম গোলযোগের ঘনঘটা। একের পর এক নিম্নচাপ পরিণত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ে। বায়ুমন্ডলে বিরাজ করছে জলীয়বাষ্পের আধিক্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে এসব অনুঘটক যুক্ত হয়ে শীতকালের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বাড়িয়ে দেয়ার আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। এবারের শীতে শীতলতার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছে উষ্ণতা। নির্বাচনী ডামাঢোলের মধ্যে তাই শীত কম অনুভ‚ত হতে পারে।
দরজায় কড়া নাড়া এবারের শীত মৌসুমের গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে তা চূড়ান্ত করতে গত সপ্তাহে দেশের আবহাওয়াবিদ এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক আবহাওয়া গবেষণা সংস্থার গবেষকরা আলোচনা করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে শীত ঋতুর দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের ফলাফল নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। তাতে এবারের শীতকাল গত বছরের চেয়েও উষ্ণ হতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ বছরের শীতকালে তাপমাত্রা বেশি থাকতে পারে। গোলযোগজনিত অতিরিক্ত উষ্ণতার প্রভাবে এরইমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এ সময়ে সাগরের তাপমাত্রা থাকে ২৭ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে তাপমাত্রা থাকছে ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে সাগরে প্রচুর জলীয়বাষ্প ও চাপ তৈরি হচ্ছে। গত সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ওই অতিরিক্ত তাপমাত্রাকেও দায়ী করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ পূর্বদেশকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় লা নিনা ও ভারত মহাসাগর দ্বি-চক্রের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেড় মাসের ব্যবধানে দুটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গোপসাগর উত্তপ্ত থাকায় এরই মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছে। আরেকটি লঘুচাপ চলতি মাসের শেষের দিকে সৃষ্টি হতে পারে। সেটি নিম্নচাপ হয়ে হয়তো ঘূর্ণিঝড়েও রূপ নিতে পারে। এসব মিলিয়ে এবার স্বাভাবিকের চেয়ে শীত কম অনুভূত হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এল নিনো সক্রিয় থাকায় আরব সাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে শুষ্ক বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে আবহাওয়া স্বাভাবিকের চেয়ে উষ্ণ থাকছে। গত বছরও শীতকাল স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তপ্ত ছিল। শীতকালে স্বাভাবিকের চেয়ে এক দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা ছিল। আর গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। গত বছরের ২০ জানুয়ারি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছিল পাঁচ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল ২৩ ফেব্রæয়ারি। বিদ্যমান আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিতে গত শীতের মতো এবারের শীতও কিছুটা উষ্ণ থাকতে পারে। তবে শীতকালের উষ্ণতা গত বছরের চেয়ে বেশি থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কার্তিকের শেষ পক্ষ থেকে কুয়াশার চাদর মোড়ানো শীত দরজায় কড়া নাড়লেও দেশজুড়ে এখনই উত্তুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে না। চলতি নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে রোদের তেজ ও রাতের তাপমাত্রা। সকালের সূর্যের কিরণে ভোরের শিশির শহরাঞ্চলে ততটা ঠাওর করা না গেলেও প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে সন্ধ্যা নামার পর হালকা হিম ভাবের আমেজ ভিন্ন অনুভূতির জানান দিতে শুরু করেছে শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের। সারাদেশে শীত আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। শীতের শুরুটা হবে উত্তরাঞ্চল দিয়ে, তারপর মধ্যাঞ্চল হয়ে সারাদেশে বিস্তার লাভ করবে। আর শহরাঞ্চলে ডিসেম্বরের আগে বলার মত শীত অনভ‚ত হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বাতাসের গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদে তাপমাত্রা কমে শীতল হাওয়া অনুভূত হতে শুরু করে। তবে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে শীত আসতে আরও সময় লেগে যায়। দেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। এছাড়া যানবাহন চলাচল ও শিল্প-কারখানার কারণে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রাও সবসময় তুলনামূলক বেশি থাকে। এ কারণে গ্রামাঞ্চলে শীতের আবহাওয়া দেখা দিলেও শহরে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগে। আবার বাতাসের যে পরিবর্তন সেটি শুরু হয় দেশের উত্তরাঞ্চল হয়েই। এই কারণে ওইসব এলাকায় আগেই শীতের দেখা মেলে।
প্রকৃতিপ্রেমী বা আবহাওয়াদিরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নিজের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ও আচরণে বর্ষপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে ছাপানো মাসভিত্তিক ঋতু বা কালের হিসাব মেনে চলাকে শিকেয় তুলে রেখেছে সেই কবে। মৌসুমের হিসাবেও সময়ের চেয়ে এখন অসময়ের চর্চাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরপরও ষড়ঋতুর দেশে হেমন্ত মানেই প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। পালাবদলের এ দোলায় কেবল জীবজগতই নয়, গা ভাসায় বৃক্ষরাজীও। বদলে যায় মানুষের জীবনধারা। ঝরে পড়ে গাছের পত্রপল্লব। শহর কিংবা গ্রামে ধুনকরদের ব্যস্ততা বাড়ে। লেপ-তোষক তৈরি ও মেরামত কিংবা শীত মোকাবেলার প্রস্তুতির উপযুক্ত সময় হেমন্ত। প্রকৃতিতে ধানের ডগা কিংবা দুর্বাঘাসের মাথায় জমতে শুরু করে শিশির বিন্দু। নদী অববাহিকায় আবছায়া হয়ে নামে হালকা কুয়াশার চাদর। কাল বা ঋতুচক্রের হিসাবে পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল হলেও দেশে শীত শুরু হয় কার্তিকের মাঝামাঝি থেকে। শরতের বিদায়ে হেমন্তের আবির্ভাব। দিনের দৈর্ঘ্য হ্রাস। রাতের তাপমাত্রা কমতে থাকা- এ যেন দুয়ারে শীতেরই কড়া নাড়া।