উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ.) একজন বুজুর্গ মহীয়সী নারী হিসেবে তাঁকে যেমন দেখেছি

20

মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আশরাফ

চট্টগ্রাম মাইজভাÐার দরবার শরিফের অন্যতম আধ্যাত্মিক মনীষী বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারী (ক.) এর সহধর্মিণী উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ.) কে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখে এসেছি। তিনি নিজ সন্তানের মতো আমাদের ¯েœহ মমতা করতেন। আমাদের পরিবারের এবং ভক্ত জনতার খোঁজ খবর রাখতেন। কোনো জিয়ারতপ্রার্থী মা বোন মহিলা দরবার শরিফে গিয়ে আম্মাজানের কাছে আর্জি পেশ করলে এবং হাজত মকসুদের কথা জানালে তিনি হাসিমুখে দোয়া করতেন, সবাইকে ¯েœহ মমতার পরশ বুলিয়ে দিতেন। তাবাস্সুম তথা ইসলাম নির্দেশিত মুচকি হাসি সব সময় তাঁর চোখে মুখে দ্যুতি ছড়াতো। উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ.) ছিলেন আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা, ভক্ত জনতার কাছে আদর্শ মুরুব্বি ও অভিভাবক।
বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার মাইজভাÐার দরবার শরিফে গাউসিয়া হক মনজিলে বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারী (ক.) রওজা শরিফে জিয়ারতে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে শত শত ভক্ত জনতা। এই ভক্ত জনতার অনেকেই বিশ্বঅলি শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারী (ক.) একমাত্র সন্তান মাইজভাÐার দরবার শরিফ গাউসিয়া হক মনজিলের সাজ্জাদানশিন রাহবারে আলম হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান (মজিআ) এর সান্নিধ্যে গিয়ে এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করে প্রতিনিয়ত ধন্য হন। ভক্ত জনতার আশা আকাক্সক্ষা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন রাহবারে আলম মওলা হুজুর (মজিআ)। বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারী (ক) জীবদ্দশায় উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ) যেমন স্বামীর সান্নিধ্যধন্য ও আধ্যাত্মিক কৃপা লাভ করে সর্বস্তরের মানুষকে বিশেষ করে শত শত নারী-শিশুর হাজত মকসুদ পূরণে নিবেদিত রেখেছিলেন নিজেকে, ঠিক তেমনি বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারীর (ক) ওফাতের পরও ভক্ত জনতার আশা ভরসা ও অনুগ্রহ লাভের উসিলা হয়ে উঠেন মা জননী হযরত সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ)। দরবার ও মনজিলে যাঁরাই মা জননীর সাক্ষাত পেতেন, বিশেষ করে হাজতপ্রার্থী নারী শিশু কিশোরীদেরকে তিনি অপাত্য ¯েœহের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতেন। হাসিমুখে ফরিয়াদিদের অভাব অভিযোগ শুনতেন। কোনো আর্জি পেশ করলে চমৎকার সমাধান দিতেন। খুবই মেহেরবানি করতেন। ফরিয়াদি মানুষ তাঁর আশীষ ও করুণা লাভে ধন্য ও অভিভূত হতেন। এমন সাদাসিধে হাসি-খুশিমাখা সহজ সরল নির্মল নিষ্কলুষ মহীয়সী নারী আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। তিনি ছিলেন অন্য হাজারো নারীদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তিনি কম ঘুমাতেন। নামে মাত্র স্বল্প আহার করতেন। দিনে রাতে কুরআন তেলাওয়াত, দুরুদ পাঠ, নামাজ ও ইবাদত বন্দেগিতেরত থাকতেন। ২০০২ সনে মা জননী উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ) এবং মওলা হুজুরের (মজিআ) সঙ্গে আমরা ১৯ জন একসঙ্গে পবিত্র হজ্ব পালন করি। মক্কা-মদিনা শরিফে মা জননী (রহ) এবং মওলা হুজুরের (মজিআ) নক্শ কদমে চলে আমরা খুবই সন্তুষ্ট চিত্তে এখলাসের সঙ্গে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করি। অনেক কথা, অনেক স্মৃতি এখনো জীবন্ত। মিনা আরাফাত মাঠে একসঙ্গে অবস্থান করেই ইবাদত বন্দেগি করেছি। মধ্যরাতে মিনা হতে আরাফাতে যেতে হবে। ১৮নং মুয়াল্লিম গেটের সামনে আমরা। দীর্ঘ লাইন ছিল এখানে। এই পথে ঢুকে গাড়িতে উঠতে অনেক সময় লাগবে। হঠাৎ মা-জান বললেন, ‘ইন্দি খুলিলি যাইত ন পাইত্তাম না। কী আশ্চর্য! মা-জানের এই কথা ও ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ এই পাশের গেইট কে যেন খুলে দিল। এই গেট দিয়ে আমরা মিনা থেকে গাড়িযোগে আরাফাতে যাই। এর আগে মিনার তাঁবুতে ক্যাম্পে আমরা অবস্থান করেছি। মা-জান মন্তব্য করলেন, ‘এঁডে তো আঁরার দেশের ওরশের মতো তাঁবুতে মানুষ। ক্যাম্পে ক্যাম্পে বহু মানুষ। মক্কা-মদিনা শরিফে মা-জানকে হুইল চেয়ারে নিয়ে দুই হেরম শরিফে নামাজ ও জিয়ারতের জন্য বহুবার আনা-নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মক্কা শরিফে জান্নাতুল মুয়াল্লায় এবং মদিনা শরিফে জান্নাতুল বাকিতে আমরা মা জননী (রহ) ও হযরত মওলা হুজুরকে নিয়ে বহুবার জিয়ারত মুনাজাত মিলাদ কিয়ামে শরিক হয়েছি। আরাফাত মাঠ থেকে মুজদালিফায় রওয়ানার প্রাক্কালে একটি ঘটনা এখনো আমার বেশ মনে পড়ে। আমরা মা জান এবং মওলা হুজুরসহ আমাদের কাফেলার সবাই মুজদালিফায় যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমাদের মুয়াল্লিমের গাড়ি সেখানে নেই। আমরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। অন্য কোনো গাড়িও সেখানে পেলাম না। হাজার হাজার মানুষ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময়ে আরাফাত মাঠের এক পাশে অন্য এক কাফেলার আমার পূর্ব পরিচিত দরবারের ভক্ত মুহাম্মদ মহিউদ্দিন নামক এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তিনি একটি খালি গাড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত। আমি তাঁকে বললাম, আমাদেরকে তাঁর গাড়িযোগে মুজদালিফায় নিয়ে যেতে। মা জান ও মওলানা হুজুরের কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। অবশেষে মহিউদ্দিনের সেই গাড়িযোগে আমরা যথা সময়ে মুজদালিফায় যাই। মা-জননী ইন্তেকালের গত বছর দুয়েক আগে থেকে নানা বার্ধক্য সমস্যায় ভুগছিলেন। এজন্য মা জানকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। তবে উনার রোগ বা শারীরিক সমস্যা অন্য দশজন রোগীর মতো নয়, কিছুটা ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়পূর্ণ। শেষ সময়ে এসে উনার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে পড়লে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার এক পর্যায়ে গত ৬ অক্টোবর ২০২১ হঠাৎ না ফেরার দেশে মওলা হাকিকির সান্নিধ্যে গমন করেন উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ)। মা-জান আজ জাহেরিভাবে আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর রুহানি ছায়া আমাদের উপর সদা বিরাজমান। এটাই আমাদের বিশ্বাস। আমি বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারী (ক) এবং শ্রদ্ধাষ্পদ মা জননীর (রহ) অনুগ্রহ ছায়া কামনা করি। উম্মুল মুমেনিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগম (রহ) ভক্ত জনতার কান্ডারী এবং হাজত মকসুদ পূরণের উসিলা। আল্লাহ পাক গাউসুল আযম মাইজভাÐারী (ক), হযরত বাবা ভাÐারী সৈয়্যদ গোলামুর রহমান মাইজভাÐারী (ক), অসিয়ে গাউসুল আযম হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাÐারী এবং বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাÐারীর (ক) উসিলায় আমাদের জীবন রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুক এবং তাঁদের উসিলায় আমাদের সব গøানি ঘুচে যাক। শান্তি সৌভাগ্য নেমে আসুক আমাদের জীবনে। মাইজভাÐারর গাউসিয়া হক মনজিলের রূপকার ও স্থপতি হিসেবে মুহতরমা উম্মুল আশেকিন সৈয়দা মুনাওয়ারা বেগমের (রহ) ত্যাগ, পরামর্শ, ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে।
লেখক : সদস্য, মাইজভাÐারী গাউসিয়া হক কমিটি, কেন্দ্রীয় পরিষদ