উপকূলে আছড়ে পড়েছে ‘সিত্রাং’

18

তুষার দেব

হেমন্তের শুরুতে আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া ‘সিত্রাং’ উপকূলে আছড়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ দেশের উপকূলে আঘাত হানে। পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূল স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশ মধ্যরাতে বরিশালের তিনকোনা দ্বীপ হয়ে ভোররাতে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার কথা ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ মঙ্গলবারও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে ইতিমধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলা এবং ওই এলাকার দ্বীপ ও চরগুলোকেও সাত নম্বর বিপদ সঙ্কেতের আওতায় রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার উপক‚লএবং সেখানকার চর ও দ্বীপগুলোকে ছয় নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পূর্বদেশকে বলেন, সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উপকূল স্পর্শ করেছে সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ। মধ্যরাতে ভোলার কাছে দিয়ে বরিশালের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশ প্রবেশ করবে বা আছড়ে পড়বে। ভোররাতে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ হয়ে ঘূর্ণিঝড়টি দেশের উপকূল অতিক্রম করবে। তাই ভোররাতের দিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের শক্তি ক্রমশ লোপ পাবে। তবে এর প্রভাবে দেশের উপকূল এবং অন্যান্য অঞ্চলে মঙ্গলবারও (আজ) বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। মধ্যরাতে আঘাত করে ভোররাতে উপক‚ল অতিক্রম করার কারণে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্রও মঙ্গলবার (আজ) জানা সম্ভব হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় প্রচারিত সর্বশেষ (১০ নম্বর) বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রবেশ ও উপকূল অতিক্রমের সময় অমাবস্যা থাকায় জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত উঁচুতে উঠতে পারে। এ কারণে দেশের উপকূলের বেশিরভাগ এলাকা ওই জোয়ারে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে ভারি বৃষ্টি যুক্ত হওয়ায় দেশের উপকূলের সবকটি জেলায় স্বল্পস্থায়ী বন্যা হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের উপক‚লের ১৫টি জেলার নদীবন্দরগুলোকে তিন নম্বর সতর্কসঙ্কেত দেখাতেও বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের উপক‚লের অন্তত ১৩টি জেলা বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বরিশাল।
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ উত্তর-উত্তরপূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে সোমবার সন্ধ্যা ছ’টায় উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে মধ্যরাত কিংবা মঙ্গলবার ভোররাত নাগাদ ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল হয়ে চট্টগ্রাম উপক‚ল অতিক্রম করতে পারে। এর প্রভাবে রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশের দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। পরবর্তী দু’দিন বা আটচল্লিশ ঘন্টার আবহাওয়ার অবস্থায় পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপক‚লীয় এলাকায় ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় বরিশাল বিভাগের খেপুপাড়ায় দেশের সর্বোচ্চ দুইশ’ ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এছাড়া একই বিভাগের সদরে দুইশ’ ৬০ মিলিমিটার, পটুয়াখালীতে দুইশ’ ৫৩, ভোলায় দুইশ’ ৪৪, খুলনা বিভাগের মোংলায় দুইশ’ ১৯ ও সদরে একশ’ ৮৭, চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুরে একশ’ ৪২ ও হাতিয়ায় একশ’ ২০, ঢাকায় একশ’ ২৫ এবং একই বিভাগের গোপালগঞ্জে একশ’ ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এ্যান’ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিভাগের উপক‚লীয় অঞ্চলে প্রায় দুইশ’ ৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার অর্থাৎ ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এর মধ্যে শুধু সন্দ্বীপে প্রাণহানি ঘটে ২৩ হাজার মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলচ্ছ্বাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের একশ’ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট-বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। ঘুর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে ধ্বংসলীলা চালানোর পর এর ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে পরদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই ঘুর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি উপকূলের মানুষ আজও ভোলেনি। এখন পর্যন্ত সেটিই চট্টগ্রাম উপক‚লে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়।