ইসলামে মুমিনের জীবনে আল্লাহু আকবর ধ্বনির গুরুত্ব ও তাৎপর্য

7

ফখরুল ইসলাম নোমানী

মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা বর্ণনার সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম শব্দ আল্লাহু আকবার। এই শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে মুমিন বান্দা তার প্রভুর প্রতি বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটান এবং রবের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যে মুমিনের অন্তরে তাকবিরের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব যত বেশি হবে তার ঈমানের প্রভাব তত বেশি প্রতিফলিত হবে। তাই ইসলামী শরিয়তে আজান ও নামাজের পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় ও জীবন-ঘনিষ্ঠ নানা অনুষঙ্গে তাকবির পাঠের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে । ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দটি মুমিনের ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। মনের ভেতর থেকে ভয়-ভীতি দূর করে। মুমিনের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘আল্লাহু আকবর’-এর প্রভাব তাকে আলোকিত করে রাখে। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুমিন সাক্ষ্য দেয় যে তারা সমগ্র জাহানের একমাত্র মালিক প্রবল পরাক্রমশালী মহান আল্লাহর বড়ত্ব মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে।
আল্লাহু আকবার ধ্বনি; বরকতময় এক মহান কলেমা। যে ধ্বনিতে মুমিনের চিত্ত প্রশান্ত হয়। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আল্লাহু আকবার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বাক্য। আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড়। তার চেয়ে বড় কেউ নেই। এই ধ্বনি এই বার্তা প্রকাশ করে। শান্তি সামর্থের সম্মান সবদিক থেকেই মহান আল্লাহ সবার ঊর্ধ্বে। আল্লাহু আকবার এমন এক মহান শব্দ যে ধ্বনি শুনে শয়তান পলায়ন করে, লজ্জিত হয়, নিন্দিত হয়। নিম্নে আল্লাহু আকবার বলার কয়েকটি প্রভাব বা উপকারিতার দিক তুলে ধরা হলো-
খুশির-সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলা সুন্নত : যে কোনো বৈধ খুশির সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলা সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম খুশির সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলতেন। সহিহ বুখারির এক দীর্ঘ বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবাদের বলেন, আমি আশা করি তোমরা সব জান্নাতবাসীর এক-তৃতীয়াংশ হবে। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ (রা.) বলেন, তখন আমরা এ সংবাদ শুনে আবার আল্লাহু আকবার বলে তাকবির দিলাম। তিনি আবার বলেন আমি আশা করি তোমরা সব জান্নাতির অর্ধেক হবে। এ কথা শুনে আমরা আবারও আল্লাহু আকবার বলে তাকবির দিলাম। তিনি বলেন, তোমরা তো অন্য মানুষের তুলনায় এমন, যেমন সাদা ষাঁড়ের দেহে কয়েকটি কালো পশম অথবা কালো ষাঁড়ের শরীরে কয়েকটি সাদা পশম।
আগুন নেভাতে আল্লাহু আকবার সাহায্য করে : নবীজি (সা.) বলেছেন যখন তোমরা কোনো জায়গায় আগুন লেগে গেছে দেখো, তখন আল্লাহ আকবার বলতে থাকো । কেননা তাকবির আগুন নেভাতে সহায়ক। আরেক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন তোমরা আগুন নেভাতে তাকবিরের সাহায্য নাও।
যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহু আকবারের প্রভাব : এক বর্ণনায় বসনিয়ার যুদ্ধে মুজাহিদদের অবস্থানের কথা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে যখন মুজাহিদরা ময়দানে আসতেন এবং আল্লাহু আকবার বলে ধ্বনি উচ্চারণ করতেন । আল্লাহর শপথ! তখন বিপুল পরিমাণে যুদ্ধাস্ত্র থাকা সত্তে¡ও সে অঞ্চলে একটা মুশরিক পুরুষ পাওয়া যেত না। সহিহ বুখারির বর্ণনায় আছে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) অতি সকালে খায়বার প্রান্তরে প্রবেশ করেন। সে সময়ে ইহুদিরা কাঁধে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা যখন তাঁকে দেখতে পেল তখন বলতে লাগল মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে, মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে ফলে তারা দুর্গে ঢুকে পড়ল । তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর উভয় হাত তুলে বললেন আল্লাহু আকবর, খায়বার ধ্বংস হোক।
আল্লাহু আকবার বলার কারণে শয়তান দূর হয় : তাকবির তথা আল্লাহু আকবার হলো এমন একটি বাক্য, যা কাফির এবং তাদের নেতৃবৃন্দ ও ইবলিসের মনে প্রচন্ড কম্পন সৃষ্টি করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন শয়তান যখন সালাতের আজান তথা (আল্লাহু আকবারের আওয়াজ) শুনতে পায়, তখন বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালাতে থাকে, যেন আজানের শব্দ তার কানে পৌঁছতে না পারে। মুয়াজ্জিন যখন আজান শেষ করে তখন সে ফিরে এসে (সালাত-আদায়কারীর) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। সে পুনরায় যখন ইকামাত শুনতে পায় আবার চলে যায় যেন এর শব্দ তার কানে না যেতে পারে । যখন ইকামাত শেষ হয় তখন সে ফিরে এসে (সালাত আদায়কারীদের অন্তরে) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে।
আল্লাহু আকবার বলার মাধ্যমে অহংকার দূর হয় : মানুষের জীবন ধ্বংসকারী মারাত্মক একটি স্বভাব হলো অহংকার। এই স্বভাবের লোকেরা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র, এমনকি নিজ পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে বলেন পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না। কেননা তুমি তো কখনোই পদভারে পৃথিবী বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর উচ্চতায় কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।
এই স্বভাব থেকে বাঁচতে প্রয়োজন খুব বেশি পরিমাণে তাকবির বা আল্লাহু আকবার পাঠ করা। কারণ মুমিনের অন্তরে যখন আল্লাহ সবচেয়ে বড় এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে স্থাপন হবে তখন সব অহংকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তর পবিত্রতা লাভ করবে। আর এটিই আল্লাহু আকবারের সবচেয়ে বড় প্রভাব।
আল্লাহু আকবারের মাহাত্ম্য অনুধাবন-অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে : যখন কোনো মুমিন বান্দা মনের গভীর থেকে আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করবে, তাকবিরের গুরুত্ব অনুধাবন করবে, সে গুনাহ ও সীমা লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে পারবে। কারণ যে মুমিনের অন্তরে সত্যিকারার্থে আল্লাহর সম্মান ও ভয় থাকে, সে কখনো গুনাহে লিপ্ত হতে পারে না ; বরং তাকবিরের মর্মার্থ না বোঝার কারণেই মূলত মানুষ গুনাহের দিকে ধাবিত হয়। ইরশাদ হয়েছে,‘আর কেউ আল্লাহর শাআইর (নিদর্শন)-কে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।
আল্লাহু আকবার হজের সময় : মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থান বায়তুল্লাহ হজ। সেই পবিত্র ঘর জিয়ারতকালে উচ্চ স্বরে তাকবির বলতে হয়। কঙ্কর নিক্ষেপ করার সময়, আরোহণ করা, নিচে অবতরণ করা, তাওয়াফ করাসহ এ ধরনের সব জায়গাতেই আল্লাহু আকবার বলতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, জিলহজের এই ১০ দিন আল্লাহর কাছে তাকবিরের চেয়ে আর বড় কোনো আমল নেই।
আল্লাহু আকবার তাকবিরের খোলে আসমানের দুয়ার : একবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায়কালে এক ব্যক্তি বলে উঠল ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা ওয়াল হামদুলিল্লাহ কাসিরা ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওয়া আসিলা’ (অর্থ : আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর । আর সকাল ও সন্ধ্যায় তারই পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে)। নামাজ শেষে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন এ কথাগুলো কে বলল? সবার মধ্যে থেকে জনৈক বলল হে আল্লাহর রাসুল! আমি ওই কথাগুলো বলেছি। তখন রাসুল (সা.) বললেন কথাগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ কথাগুলোর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। আর আল্লাহু আকবার ‘শাআইরে ইসলাম’ এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি এর মর্যাদা রক্ষা করবে সে সব ধরনের গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবে।
আল্লাহু আকবার নামাজে তাকবির : আজানের মধ্যে তাকবির বলতে হয়। ঈমানের পর সবচেয়ে যে হুকুম নামাজ। সেই নামাজ শুরু হয় তাকবির তথা আল্লাহু আকবর দিয়ে। তেমনি নবজাতকের কানে তাকবির বলা। মৃত ব্যক্তির জন্য জানাজায় তাকবির বলা ইসলামের বিধান।
আল্লাহু আকবার সফরে : রাসুল (সা.) যখন বাহনে আরোহণ করতেন, তখন তিনি আল্লাহু আকবার বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কোথাও সফরের উদ্দেশে তাঁর উটে আরোহণের সময় তিনবার আল্লাহু আকবার (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) বলতেন।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘সুবহানাল্লাহ,ওয়াল-হামদু লিল্লাহ,ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ অতীব পবিত্র, সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) বলা আমার কাছে যেসব জিনিসের ওপর সূর্য উদিত হয় তা থেকে বেশি পছন্দনীয়। প্রিয়নবী (সা.)-বলেছেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশকে তোমরা বেশি বেশি তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বলবে।
পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি, হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। মহান আল্লাহ আমাদের বেশি বেশি আল্লাহু আকবার তথা তাঁর মাহাত্ম্য ও বড়ত্ব বর্ণনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট