ওয়াসিম আহমেদ
পাহাড়ের পাদদেশে জল-সবুজের পাহারায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ মিনার আর নেই! বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের ইট-পাথুরে আয়োজনে থেকেও যেন নেই বাঙালির আবেগ-চেতনার সম্মিলনস্থল কেসিদে রোডের ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। টিনের ঘেরায় প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে সুউচ্চ দালান গড়ে ওঠেছে। অথচ যে শহীদ মিনার নিয়ে এতো আয়োজন, চোখের সামনে থেকে সে শহীদ মিনার সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠে গেছে, চোখের আড়াল হয়েছে সবার। এ নিয়ে বাঙালির চেতনা লালন করা হৃদয়গুলো মর্তাহত হয়েছে। সংস্কৃতিকর্মী ও আমজনতার মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। এমনকি সচেতন মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছে, ‘আমার শহীদ মিনার কোথায়?’
গতকাল পড়ন্ত বিকালে কেসিদে রোডে শহীদ মিনারের খোঁজে সরেজমিনে গিয়ে রীতিমত হতভম্ব হওয়ার উপক্রম। হেঁটে গিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও শহীদ মিনার নেই। সবুজ, জলাধার সবই উধাও। চলাচলের রাস্তায় ফ্লাইওভারের মত স্থাপনা। নির্মাণকাজে রত এক শ্রমিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি শহীদ মিনারের সিঁড়ি দেখিয়ে দেন। একসাথে শ’দুয়েক মানুষ উঠলে যে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটা-চলা দায় হবে, সেই সিঁড়ি দিয়ে হাজার হাজার মানুষের ঢল কিভাবে শহীদ মিনার পৌঁছাবে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়া মস্তিষ্কে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কমপ্লেক্সের সুবিশালতা নজর কাড়ছে। পার্কের মত বসার স্থান, উঁচুনিচু সিঁড়ির আধিক্য যেন প্রাণ কেড়ে নিয়েছে শহীদ মিনারের। এ ছাড়া কমপ্লেক্স থেকে বের হওয়ার পথ ধরে এগোতেই দেখা মেলে সড়ক দখল করে পার্কিং বাণিজ্যের চিত্র। সড়ক দখল করে করা হয়েছে কমপ্লেক্সের স্থাপনা। থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সামনে শহীদ মিনারের প্রবেশপথ দখলে চলে গেছে গাড়ি পার্কিংয়ের। যেন পরিকল্পিত নকশায় গড়ে উঠা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের ইট-পাথুরে আয়োজন শুধু শহীদ মিনারকে ম্লান করেনি, নিউ মার্কেটের মত জনবহুল এলাকায় যানজটের কারণও হবে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
গত শনিবার সকালে একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমানসহ বিভিন্ন অঙ্গনের একদল বিশিষ্টজনকে নিয়ে শহীদ মিনার পরিদর্শনে যান সিটি মেয়র। এরপর মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আলোচনার প্রসঙ্গে মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা পরিদর্শন করে দেখেছি। এটি কোনোভাবে শহীদ মিনার হয়নি। সিঁড়ি বেয়ে দুইতলায় শহীদ মিনার হতে পারে না। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও শহীদ মিনার কোনটা টের পাওয়া যাবে না। যে শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে এতো উঁচু উঁচু ভবন, সেই চেতনার স্থাপনা নিয়ে অবহেলা কোনোভাবে মানা যায় না। তাই বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের বলেছি, কিভাবে করবেন, তা জানি না। তবে করতেই হবে সেটা জানি। সংস্কৃতিকর্মী, বিজ্ঞজনদের নিয়ে কমিটি করে দিয়েছি, তাদের পরামর্শক্রমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ নিয়ে ইতোমধ্যে সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন মহলের মধ্যে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক জাহেদ মোতালেব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার শহীদ মিনার কোথায়? কেসি দে রোডে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়ত শহীদ মিনারের বিশালতা, আশপাশের সবুজ, মিনারের সামনের ছোট্ট জলাশয়, শাপলা, একটি-দুটি মাছের লাফালাফি, দুই পাশের খোলা জায়গা, পেছনের কৃষ্ণচ‚ড়া গাছ। এই শহীদ মিনার ছিল আমার আপন। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে আসত। ভালো লাগত। স্যান্ডেল খুলে কতবার সিঁড়িতে বসে এই বাংলার জন্য যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনুভব করার চেষ্টা করেছি। সিঁড়িতে হাত বুলিয়ে পেয়েছি তাঁদের স্পর্শ। কখনো কখনো পাশের সবুজ চত্বরে হেঁটে বিভিন্ন ফুলের গাছ, ফুল, নানা রঙে মজেছি। সেই এক সময় ছিল। তারপর সেদিন নির্মাণাধীন সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে ঢুকতে হলো। পাবলিক লাইব্রেরির কর্তাদের কাছে মেয়ের একটি ফরম জমা দেব। ঢুকতে গিয়ে রাস্তা থেকে আর শহীদ মিনার দেখলাম না। কোথায় শহীদ মিনার? কোথায় সবুজ? কোথায় নরম রোদের মতো, বৃষ্টির ফোঁটার মতো, কর্ণফুলীর ¯্রােতের মতো মিনার, তার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, দৃঢ়তার সেই মিনার কোথায়? তাকে তো খুঁজে পাচ্ছি না। মাথার উপর খোলা আকাশ নয়, দেখলাম দৈত্যের মতো দেয়াল। পাশেও দেয়াল। এই দেয়াল শহীদ মিনারকে আড়াল করে বিকট মুখে হাসছে। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের নামে এ কি হলো! এ রকম চিন্তা কোন মাথা থেকে এল? এ-ও সম্ভব! মন খারাপ করে হেঁটে গেলাম। আমার সঙ্গে যেন আমার সেই শহীদ মিনারও হাঁটছে। সেদিন থেকে আমার খুব রাগ। এই রাগ আমি কার ওপর প্রকাশ করব?’
অন্যদিকে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাবু পূর্বদেশকে বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, শুনেছি। আমাকে কেউ ডাকেনি। তবে যারা এ শহীদ মিনার বাস্তবায়ন করছেন, তাঁদের উচিত ছিলো প্রথম থেকে সংস্কৃতিকর্মী ও সংশ্লিষ্টজনদের সাথে সমন্বয় করা। এখন নিজেদের মত শহীদ মিনার করায় সমস্যাটি তৈরি হয়েছে। তাই সবার সাথে বসে সমস্যা সমাধান করতে হবে। শহীদ মিনার আবেগ-চেতনার জায়গা, তাই কোনো হেলাফেলা করা চলবে না।’
জানা গেছে, ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কে সি দে রোডে মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভেঙে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপ‚র্ত বিভাগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে আছে, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরির অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা অডিটরিয়াম ভবন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংস্কার, ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং ক্যাফে ও মিনি মিউজিয়াম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন।
২০২১ সালের অক্টোবরে আগের শহীদ মিনার ভাঙ্গার আগে সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। তারা দাবি করেছিলেন, বর্তমান অবয়ব ঠিক রেখেই সংস্কার করতে হবে। তখন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, শহীদ মিনারের মূল নকশার কোনো পরিবর্তন করা হবে না। কিন্তু সংস্কারকাজ শেষে পরিদর্শনের পর নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ‘শহীদ মিনারের আগের অবয়ব ঠিক আছে। কিন্তু আগে যে রাস্তা কিংবা আশপাশের এলাকা থেকে মাথা উঁচু করে থাকা শহীদ মিনারটা আমরা দেখতাম, সেটা আর নেই। এক কথায়, শহীদ মিনারের বিশালতাটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স একটা বিশাল স্থাপনা, কিন্তু পুরো স্থাপনার মধ্যে শহীদ মিনারটা একেবারে ছোট হয়ে গেছে। দুইদিকে বøক করে ফেলা হয়েছে।’
‘আগের চেয়ে অনেকবেশি উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে। এত সিঁড়ে ভেঙ্গে উপরে উঠতে হচ্ছে যে, বয়স্ক কিংবা শারীরিকভাবে যাদের প্রতিবন্ধকতা আছে, তাদের জন্য রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। ঢাকার যে শহীদ মিনার কিংবা আমাদের আগেরটা, বড় স্পেস, অনেকে একসঙ্গে উঠতে-নামতে পারত। এখন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে আমাদের জাতীয় দিবসগুলোতে যে একসঙ্গে হাজার হাজার লোক হয়, তারা কিভাবে যাবে-আসবে?’
জানা গেছে, সভায় আবুল মোমেনও শহীদ মিনার নিয়ে আপত্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের শহীদ মিনারকে হিজাব পরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তো একটি মুক্ত স্থাপনা চেয়েছিলাম। আগের মতো একই অবয়বে একটি স্থাপনা চেয়েছিলাম। এভাবে ইট-পাথরে ঢাকা শহীদ মিনার আমরা চাইনি। এটা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।’
ডাক্তার মাহফুজুর রহমান, আহমেদ ইকবাল হায়দার, আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশ গুপ্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠক দেওয়ান মাকসুদ আহমেদও সভায় প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, সংস্কার কার্যক্রমের জন্য নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে গত দুই বছর ধরে জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয়ে আসছিল।