আমলাতান্ত্রিকতা ও গাড়িবিলাসের খেসারত প্রসঙ্গে

5

ডা. হাসান শহীদুল আলম

নির্বাচনে দৌড়-ঝাঁপ বাড়বে আমলাদের। কথাটি সত্যি। সময় ও পরিশ্রম বাঁচাতে গাড়ি দরকার।সরকারি গাড়ি নেই এমন কোন ডিসি-ইউএনও নেই।কথা হচ্ছে গাড়িগুলো পুরানো হয়ে গিয়েছে ।এ সব গাড়িতে দৌড়-ঝাঁপ করলে শরীরে ব্যথা ও ক্লান্তি অনুভূত হবে মহোদয়গণের।গাড়ি মেরামত করলেই তো হয়। দু’দিনের দৌড়-ঝাঁপের জন্য এটাই তো সমাধান। কিন্ত পুলিশ যে নুতন দামী গাড়ি ব্যবহার করছে ? প্রশাসনিক মহোদয়গণদের চেয়েও দামী গাড়ি। মহোদয়গণদের প্রেস্টিজে লাগবেই তো।অতএব পুলিশের চেয়েও দামী গাড়িতে মহোদয়গণদের চড়াতে হবে।অতএব মহোদয়গণদের জন্য নূতন গাড়ি চাই।
সত্বর মহোদয়গণদের গাড়ি কেনার সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। ” আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডিসি ও ইউএনওদের জন্য চাই সর্বাধুনিক মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি। মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স মডেলের এসব জিপ গাড়ির এক একটির বাজারমূল্য ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। এমন উচ্চমূল্যের ৪৬১টি গাড়িসহ চলতি অর্থবছরে মোট ৮৪০টি বিলাসবহুল গাড়ি ও ১৩২টি স্পিডবোট কিনতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর।সব মিলিয়ে ৯৭২টি গাড়ি ও স্পিডবোট কেনায় এই অর্থবছরে মোট প্রয়োজন হবে ১ হাজার ১৬২ কোটি ২৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এ জন্য নিয়মিত বরাদ্দের অতিরিক্ত ৬১২ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ( কালবেলা, ১৭-০৭-২৩)।”
নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলেছে বর্তমানে বিলাসবহুল গাড়ি কেনাটা উচিৎ হচ্ছে কিনা। বৈশ্বিক অস্থিরতায় দেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে সরকার নিজেই চলছে ধার-কর্জের মাধ্যমে। ব্যয় কমাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।সরকারিভাবে সব ধরনের গাড়ি, বিমান ও জাহাজ কেনাকাটা বন্ধ রাখা হযেছে। সরকারি চাকুরীজীবীদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমন, কর্মশালা, সেমিনারে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কিন্ত বিধি-নিষেধ ঘোষণার তিন সপ্তাহের মধ্যেই গাড়ি কেনার আবদার করে বসলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায় যে, মহোদয়গণদের জন্য সর্বশেষ ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ২৫৫টি গাড়ি কেনা হয়েছিল। সে সময় প্রতিটি গাড়ি কিনতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৮ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। চলতি বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল মহোদয়গণদের জন্য ৫৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দামের গাড়ি কেনার। সে অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১০ই জানুয়ারি, ২৩ ইউএনওদের গাড়ি কেনার প্রস্তাবে সম্মতি দেয়া হয়।এ সম্মতির চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছার পর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা আপত্তি জানাতে থাকেন। তাঁরা আরও দামী গাড়ি কেনার পক্ষে অবস্থান নেন।
কেন মহোদয়গণ আরো দামী গাড়িতে চড়তে চাচ্ছেন ? যেহেতু পুলিশের চেয়ে কম দামের গাড়িতে চড়তে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রেস্টিজে লাগবে। তাই সুপরিসর,শক্তিধর ও পর্যাপ্ত গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেনসের ফোর হুইল ড্রাইভের যে গাড়ি ব্যবহার করেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও সমমানের কর্মকর্তারা, সেই গাড়ি কেনা হচ্ছে মাঠ প্রশাসনের জুনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য।এখন কথা হচ্ছে যে কারনে ডিসি ও ইউএনওগণ পুলিশের ব্যবহৃত গাড়ির চেয়েও দামী গাড়ি দাবি করছেন সেই একই কারনে যদি গ্রেড-১,গ্রেড-২ কর্মকর্তাগন ডিসিদের চেয়েও দামী গাড়ি দাবি করে বসেন তখন কি সরকার শীর্ষ মহোদয়গণদের বরাদ্দকৃত মূল্যের চেয়েও আরো বেশী দামী বিলাসী গাড়ি না দিয়ে পারবেন ? বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মত অনুযায়ী ইউএনওদের জন্য এতো বিলাসবহুল গাড়ি কেনার নেপথ্যে মনস্তাত্তি¡ক দ্বন্ধ রয়েছে।সাধারণতঃ পুলিশের কর্মকর্তারা বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। তাদের কাজের ধরনের জন্যই বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে হয়।তাদের সংগে পাল্লা দিয়ে এবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্যও বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হচ্ছে।গত বছর সহকারী কমিশনারদের(এসিল্যান্ড) গাড়ি কেনা হয়েছে প্রতিটি ৫২ লাখ টাকা দরে।ইউএনওদের তুলনায় এসিল্যান্ডরা অনেক বেশী প্রান্তিক এলাকায় যাতায়াত করেন।তারা ৫২ লাখ টাকার গাড়িতে চলাচল করতে পারলে ইউএনওরা কেন পারবেননা।
অতএব সরকারের নতুন নির্দেশনা এলো।” সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরও দামী গাড়ি কেনার জন্য ১ আগস্ট, ২৩ মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন ও শুল্ক কর সহ গাড়ির দাম নির্ধারন করে নতুন নির্দেশনা জারি হয়।সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ,সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এখন সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে (দিকদর্শন,০৭-০৮-২৩)।”
এদিকে নিন্দুকেরা শোরগোল তুললো।সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বললেন,’আগে ইউএনওদের যে মানের গাড়ি দেয়া হয়েছিল এখনো সেই মানের গাড়ি দেয়া উচিৎ।অযথা খরচ বাড়ানো উচিৎ নয়। তাছাড়া গাড়ি কেনার পর তার রক্ষণাবেক্ষনে অনেক অনিয়ম হয়। পুরানো গাড়ি আমদানীকারকদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি বললেন,ডিসি ও ইউএনওদের যে গাড়ি দেয়া হয়, তা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করলে ২৫ বছর পর্যন্ত চালানো সম্ভব। ভারতে সরকারি কর্মকর্তারা অনেক কম দামী গাড়ি ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন। এটা অপচয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বললেন, কৃচ্ছসাধনে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। কারন, এখনও বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ বাড়ছে,মজুত কমছেই। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মকর্তাদের নতুন গাড়ি কেনা কিছুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি এম আজিজুল ইসলাম বলেন,বর্তমান রাজস্ব আহরন পরিস্থিতি ভালো নয়।এই মুহূর্তে গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত সরকার না নিলেই ভালো হতো।তারা প্রতিস্থাপনের কথা বলছে। কিন্ত সব গাড়ি কি একসংগে অচল হয়েছে ?
এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার পরিপ্রেক্ষিতে উপসংহারে বলতে চাই যে, অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে সরকারের অত্যধিক আমলাতোষন প্রকারান্তরে সরকারকে অধিকতর আমলানির্ভর করে তোলে।এতে আমলাদের মধ্যে ক্ষমতালোভ বৃদ্ধি পায়। আর ক্ষমতা ছিনতাইযের ধান্ধায় বিবিধ কলকাঠি নাড়ানোতে সামরিক ও বেসামরিক আমলারা উভয়ে উভয়ের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। পরিনতিতে জনপ্রতিনিধিগন ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন এবং জনগনের আস্থা হারাতে থাকেন। ফলে দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক লুঠেরা চক্র হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরনে এই লুঠেরা চক্র তাদের দেশীয় এজেন্টদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। শেষপর্যন্ত অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আরোহন করে এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য জাতীয় সম্পদ লুন্ঠিত হতে থাকে। অতএব জাতিকে সময় থাকতে সাবধান হতে হবে।

লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মরোগে, ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক