আবু সয়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক। কলকাতায় ওয়েলেসলি স্ট্রিটে পিতামহের বাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতা আবুল মোকারেম আববাস ছিলেন বড়লাটের করণিক, মাতা আমিনা খাতুন। তাঁর বড় ভাই ডাক্তার আব্দুল গনি ছিলেন সাবেক ভারতীয় রেলমন্ত্রী। ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের কন্যা অধ্যাপিকা গৌরী দত্ত ছিলেন তাঁর স্ত্রী। পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর এক সময় তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুব দত্ত নামে কিছু রচনা প্রকাশ করেন।
আইয়ুবের শৈশবের কিছুকাল সিলেটে অতিবাহিত হয়। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি কলকাতার সেন্ট এন্টনিজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আই এসসি পাস করেন। আকৈশোর ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী আইয়ুব ছিলেন মানসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় তীক্ষ্ণ এবং পরিশীলিত। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করে তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে আগ্রহী হন এবং অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সাহায্যে এডিংটনের Mathematical Theory of Relativity-র ওপর অধ্যয়ন করেন; কিন্তু অসুস্থতার কারণে এম এসসি পরীক্ষা না দিয়ে তিনি বিভাগ পরিবর্তন করে দর্শনে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ভারতের বিখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণন ও অধ্যাপক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে Content of Error in Perception and Thought বিষয়ে গবেষণা করেন।
অল্পসময়ের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি ও কৃষ্ণনগর কলেজে অধ্যাপনা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪-৫৬ সালে তাঁকে রকফেলার ফাউন্ডেশনের ফেলো নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডিয়ান স্টাডিজ খোলা হলে তিনি এর প্রথম বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত সিমলার ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এ ফেলোরূপে কর্মরত ছিলেন। অসুস্থতার কারণে আইয়ুবের কর্মজীবনে ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি বটে, কিন্তু চিন্তাশীলতায় তিনি ছিলেন একান্তভাবে আত্মমগ্ন, কখনও কখনও সৃষ্টিমুখর; বন্ধু ও সজ্জন সভায় তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ বক্তা ও বিতার্কিক। তিরিশের দশক থেকে তিনি পরিচয় ও চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রবন্ধাদি প্রকাশ শুরু করেন। ত্রৈমাসিকরূপে প্রকাশিত এ দুটি পত্রিকা ছিল অতি উঁচুমানের এবং বুদ্ধিজীবী মহলের পর্যালোচনামূলক মুখপত্র। ১৯৪২ সালে কলকাতায় ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ আয়োজিত প্রথম রাজ্য সম্মেলনে তিনি ছিলেন সভাপতিমন্ডলীর অন্যতম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সমর্থন এবং বুদ্ধিজীবীদের সহায়তাদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। বস্তুত, চল্লিশ থেকে ষাটের দশক অবধি দেশিয় ও আন্তর্জাতিক জটিল রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে সা¤প্রদায়িকতা ও মতাদর্শের প্রশ্নে বিবদমান পরিস্থিতিতে আইয়ুব আশ্চর্য মানসিক স্থৈর্য বজায় রাখতে ও নিরপেক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হন। সম্ভবত দার্শনিক ও নন্দনতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে ররীন্দ্রভাবনা তাঁকে এ আত্মিক উত্তরণে সহায়তা দিয়েছিল। তাঁর জীবনের বড় অংশ কেটেছে রবীন্দ্ররচনা অধ্যয়ন ও তার সার্থক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও নাটক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং জীবন ও জগৎকে রবীন্দ্রবীক্ষায় উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিবিভ্রাট ও অপরোক্ষানুভূতি’ ত্রৈমাসিক পরিচয় (১৯৩৪) পত্রিকায় প্রকাশিত হলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও অতুলচন্দ্র গুপ্ত এর প্রশংসা করেন। সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে দিয়ে দ্রæত ‘সুন্দর ও বাস্তব’ (১৯৩৪) শীর্ষক প্রবন্ধ রচনা করান। আইয়ুবের মতে, এ প্রবন্ধ থেকেই তাঁর রবীন্দ্রচর্চার সূত্রপাত।
আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রকাশনা তালিকা খুব দীর্ঘ না হলেও অত্যন্ত মূল্যবান। তাঁর আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮) গ্রন্থটি কলকাতার সাহিত্য-জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতামালা চড়বঃৎু ধহফ ঞৎঁঃয (১৯৭০) দর্শন ও কাব্যব্যাখ্যায় তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। পরবর্তী গ্রন্থ পান্থজনের সখা ও (১৯৭৩) পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র-কাব্যব্যাখ্যা ও কিছুটা পূর্ব গ্রন্থের সম্পূরক। পথের শেষ কোথায় এবং পূর্বপ্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ: ১৯৩৪-৬৫ (১৯৭৭) তাঁর সাহিত্যচিন্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে ব্যাপ্তি সে বিষয়ে পাঠককে দিগদর্শনের ইঙ্গিত দেয়। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ গালিবের গজল থেকে (১৯৭৬) উর্দু সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ এবং তাঁর প্রিয় কবি গালিব সম্পর্কে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রতিতুলনায় রবীন্দ্র-বিশ্লেষণের একটি প্রাঞ্জল রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে। এ ছাড়া রয়েছে, ঙহব ঐঁহফৎবফ ধহফ ঙহব চড়বসং নু জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব (১৯৬৬) ও মীরের গজল থেকে। সম্পাদনা-সূত্রে জড়িত তাঁর তিনটি প্রকাশনা খুবই বিখ্যাত: আধুনিক বাংলা কবিতা (হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সহযোগে, ১৯৪৭), পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা (১৯৬৩) এবং ১০ ুবধৎং ড়ভ ছঁবংঃ (অস্মান দত্ত সহযোগে, ১৯৬৬)। এ ছাড়া প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থ ঠধৎরবঃরবং ড়ভ ঊীঢ়বৎরবহপব (১৯৮০), ঞধমড়ৎব’ং ছঁবংঃ (১৯৮০) এবং ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক আইয়ুবের সুদীর্ঘ সাধনার সাক্ষর বহন করে।
রবীন্দ্রানুসারী শিল্পবোধের সূ²াতিসূ² রূপ, আধুনিক মনন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসন্ধান আবু সয়ীদ আইয়ুবের জীবন-সাধনা। খুব বেশি না হলেও তাঁর মৌলিক ও শিল্পনৈপুণ্যে ভাস্বর রচনাবলি তাঁকে বাংলার সাহিত্য-আসরে একটি বিশিষ্ট আসনে অভিষিক্ত করেছে। তাছাড়া সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ভ্রান্তি নিরসনে, সত্য, সুন্দর ও শ্রেয়কেই জাগ্রতকরণে তিনি সবচেয়ে সংস্কৃতিবান ও নাগরিকতাসম্পন্ন চিন্তাবিদরূপে চিহ্নিত।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ১৯৬৯ সালে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ১৯৭০ সালে দিল্লির ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ এবং ১৯৭১ সালে বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৮০ সালে টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে ‘রবীন্দ্র তত্ত¡নিধি’ উপাধি প্রদান করে। দীর্ঘকাল পার্কিনসন্স রোগে ভোগার পর ১৯৮২ সালের ২১ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। সূত্র : বাংলাপিডিয়া