১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও জঘন্য ঘটনা। দানবচক্র বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্য-সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, এমনকি ছয়-সাত বছর বয়সী শিশু রাসেলসহ নিকটাত্মীয়, যাঁদের হাতের নাগালে পেয়েছে তাঁদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় ঘাতকের বুলেট তাঁদের ছুঁতে পারেনি।
১৯৯৬-২০০১ এর জুলাই পর্যন্ত এবং ২০০৯ থেকে বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বাদে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগীরা। তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কর্মকান্ড, পাকিস্তানি ভাবধারায় সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং সাম্রাজ্যবাদের তোষণ নীতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে এই হত্যাকান্ডের আসল হোতা কারা এবং তাদের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভেতর পরম বন্ধুবেশি চরম শত্রুদের অনেককেও চেনা গেছে যাঁরা দলের দুর্দিনে মোশতাক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে বেঈমানী করেছিলেন। স্বস্তির কথা, সব নেতিবাচক অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আশলে আদালতের রায়ে হত্যাকারীদের বড় অংশের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। যদিও ঘটনার নেপথ্যের কলাকুশলীবদের অনেকে এখনো বিচারের আওতার বাইরে থেকে গেছে আপাত তথ্য-প্রমাণের অভাবে। স¤প্রতি দাবি উঠেছে নেপথ্যের কুশিলবদের খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য।
লক্ষ্য করা গেছে, কিছু লোক এই বলে অপপ্রচার চালান যে, বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতার হত্যাকাÐের পর কোথাও কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়নি। তারা বোঝাতে চান যে, ৭৫ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা অত্যন্ত কমে গিয়েছিল। তাই নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর নৃশংস হত্যাকাÐের পর ‘টু শব্দ পর্যন্ত করেননি’। আসলে এমন অপপ্রচারের মাধ্যমে তারা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত এবং বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখাতে চান।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ঘটনার আকস্মিকতায় সাধারণ মানুষসহ নেতা-কর্মীর মধ্যে প্রথমে বিভ্রান্তি দেখা দিলেও দেশের অনেক জায়গায় সেদিনই প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। পরবর্তী দু-তিন মাসের মধ্যে দেশের একটি বড় অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল বৃহত্তর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কর্মসূচি যা পরবর্তী দু বছরে একাত্তরের গেরিলা যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তাৎক্ষণিক নির্দেশনা না পাওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর পরিসরে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠার কারণগুলোও বিবেচনা করা প্রয়োজন।
যেমন: ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমণকে ঘিরে কর্মসূচির পরের দিন ছিল নবগঠিত জাতীয় যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সম্মেলন ও পরিচিতি অনুষ্ঠান। কয়েকদিন আগে থেকে চলছিল বাকশালের জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ। এসব কারণে সারা দেশের জেলা পর্যায়ের প্রায় শীর্ষ নেতা অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ডাক দেওয়ার মতো লোকজন জেলা পর্যায়ে ছিলেন না বলে চলে। তা ছাড়া, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সমন্বিত সশস্ত্র কিংবা মানসিক প্রস্তুতিও কারও ছিল না। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যে চলছিল তা দেশি-বিদেশি শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁকে ৩২ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে গণভবনে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা হিসেবে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তাঁকে মারার মতো কোনো ষড়যন্ত্র কেউ করতে পারে না। তিনি তাঁর এই সরল বিশ্বাসের কারণে কারো কথাই শোনেননি এবং কোনোরূপ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসন বা দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো নির্দেশনা দেননি।
ঘাতকচক্র অভিযানে নামে অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে। দেশের স্বার্থে সামরিক আইন জারির দোহাই দিয়ে, হত্যাকাÐের উদ্দেশ্য গোপন করে সৈনিকদের মধ্যে গোলাবারুদ বিতরণ ও তাদের গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দায়িত্বরত সৈনিকদের সকালে নতুন গুলি দেওয়ার কথা বলে তাদের আগের গুলিগুলো নিয়ে গেছে ঘাতকের দল, যাতে প্রতিরোধ সেখান থেকেও না আসে।’ এতেই বুঝা যায়, ওরা কি রকম পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছিল এবং সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তাদের লোকজনের কী রকম অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।
ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতকেরা সামরিক আইন ও কারফিউ জারির মাধ্যমে সভা-সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ভারী অস্ত্রসহ ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে শহরময় টহল দিয়ে ভীতিজনক পরিবেশ তৈরি করে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনছুর আলী, কামরুজ্জামানসহ জাতীয় পর্যায়ের নেতা, এমনকি জেলা পর্যায়ে যাঁরা সাধারণ নেতাকর্মীসহ জনগণকে প্রতিরোধের নির্দেশনা দিতে পারতেন, তাঁদের বেশিরভাগ ছিলেন বন্দী অথবা ঘেরাও হয়ে কড়া পাহারায়। এখনকার মতো এতগুলো টিভি চ্যানেল, দ্রæত যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন, ফেইস বুক, ম্যাসেঞ্জার তখন ছিল না। থানা পর্যায়ে তো বটেই, জেলা পর্যায়েও ল্যান্ড ফোন ছিল হাতে গোণা। এ অবস্থায় গণভবন, রেডিও-টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র কবজা করা মানেই পুরো দেশটাই কবজা করা। শত্রæরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাল্টা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে এমন সব দিক বন্ধ করেই তাদের কাজে হাত দেয়। ফলে পরস্পরের সঙ্গে দ্রæত যোগাযোগের অভাবে সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। অনেকেই বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল, জামাল, রাসেল, শেখ মণি, সেরনিয়াতসহ অন্যদের আকস্মিক মৃত্যু এবং ঘাতকদের হিংস্র মনোভাব দেখে জীবনের মায়ায় ভীত হয়ে নিরবে আত্মগোপন করেছিলেন। কেউ কেউ স্বেচ্ছায়, আবার কেউ কেউ সৈন্যদের অস্ত্রের মুখে যোগ দিয়েছিলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। দুর্বল চিত্তের নেতাদের এভাবে মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগদানের ফলে সাধারণ নেতা-কর্মীরা মনে করেছিলেন, কিছু সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও পরিস্থিতি ও সরকার আওয়ামী লীগেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটা যে পাকিস্তানপন্থি মোশতাকচক্র ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ষড়যন্ত্রের চরম পরিণতি, একথা যখন সবাই বুঝতে পেরেছিলেন তখন ক্ষমতাকাঠামোসহ সার্বিক পরিস্থিতি ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনুক‚লে চলে গিয়েছিল।
এরপরও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে ওইদিনই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম, বরগুনা, দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায়। ঘটনার প্রথম দিনেই চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র দখল করে জনগণকে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার আহŸান জানানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ অসংগঠিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় এ ধরনের কর্মকান্ড ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় সম্মত না হওয়ায় উদ্যোগটি বাতিল হয়। তাঁদের মত ছিল, পর্যাপ্ত অস্ত্র ও জনবলসহ নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে বাইরে কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না।
ছাত্র-কর্মীদের চেষ্টার ফলে ২০-২১ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন ও কলাভবন এলাকায় চলে সমাবেশ, মিছিল-স্লোগান। এরই মধ্যে গোপনে সংগঠিত হয়ে ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশের এলাকা ঘিরে মিছিল সমাবেশ, দেয়াল লিখন ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বাকশালভুক্ত ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এতে শিক্ষার্থী ছাড়াও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। সেখানে উপস্থিত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই দিন চট্টগ্রাম, শেরপুর, পাবনা, ভৈরব, দিনাজপুর, বরগুনা, মুক্তাগাছায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল সংঘটিত হয়েছে। তবে সবকটি মিছিল সমাবেশই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হামলার কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরই ফাঁকে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী বিরোত্তম। একই রকম চিন্তা নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিলেন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন কলেজ ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। নভেম্বরে পর্যায়ক্রমে তাঁদের অনেকে গিয়ে যোগ দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। গঠিত হয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। প্রতিরোধ যোদ্ধারা নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে কখনো বাংলাদেশ, কখনো ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী ও বিডিআরের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
একইভাবে চট্টগ্রামের তৎকালীন ছাত্র ও যুবনেতা, একাত্তরে চট্টগ্রাম শহর গেরিলা বাহিনীর প্রধান মৌলভি সৈয়দ আহমদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (চট্টগ্রামের প্রয়াত সিটি মেয়র), যুদ্ধকালীন বিএলএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার এসএম ইউসূফ তাঁদের অনুসারীদের সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধমূলক নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ যুব ও ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী ক্রমান্বয়ে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। ৭৭ সাল পর্যন্ত চলমান ওই যুদ্ধে দুপক্ষেরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য হতাহত হয়। দেশের ভেতরেও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে কিছু কাজ করেছেন তাঁরা। সামরিক সরকারের নির্যাতনে কারাগারে প্রাণ হারাণ মৌলভি সৈয়দ।
কিছুটা সশস্ত্র কর্মকান্ডের মাধ্যমে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বৈঠক-সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ, দেয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়-যাতে জনমনে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে দলকে সংগঠিত করে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।
পরবর্তী সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়ে সরকার গঠন করার মাধ্যমে দেশকে ক্রমান্বয়ে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করলেও ষড়যন্ত্র কখনো থেমে ছিলা না, এখনো থেমে নেই।
খন্দকার মোশতাকসহ ঘাতক ও সুবিধাভোগীদের অনেকে এখন নেই। তারপরও পঁচাত্তরের খুনি এবং পরবর্তী সময়ের সুবিধাভোগী মৌলবাদীসহ একাধিক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণকারীদের নির্মূল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠে শেখ হাসিনার জনসমাবেশে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন কর্মী নিহত হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত ও তিন শতাধিক আহত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেখ হাসিনার কান। এ ছাড়া, আরও অন্তত ১৮-২০ বার অঘটন ঘটানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। এসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় কুচক্রীদের ছোট-বড়ো এজেন্টরা কৌশল পাল্টে ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রশাসনের নানা স্তরে বন্ধুতার মুখোশ পরে অনুপ্রবেশ করছে বলে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তারা অতীতের মতো দলীয় কিছু নেতা-কর্মীর বন্ধু সেজে ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে এবং এ সুযোগে বঙ্গবন্ধু ও দলের নীতি-আদর্শ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করছে। তারা যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলসহ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে কবজা করে উন্নয়নের যাত্রাপথে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে তার আলামতও স্পষ্ট। এর আগে সাবেক স্থানীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্য মতের লোকজন ঢুকে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদকও দলে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে বলে ইতিমধ্যে স্বীকার করেছেন। সাম্প্রতিককালে সরকারের জন্য বেশ কিছু বিব্রতকর ঘটনার পেছনে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে বলে নানাভাবে আলোচিত হয়েছে।
অনুপ্রবেশকারীরা মিছিল-সমাবেশে যোগদান, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার পক্ষে বাহু উঁচিয়ে গলা ফাটানো ¯েøাগান এবং ফাঁক ফাকরে ঢুকে কৌশলে জ্যেষ্ঠ নেতা-মন্ত্রীদের পাশে গিয়ে ছবি তুলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বলে জাহির করেন। কিন্তু তাদের অতীত কর্মকাÐ ঘাঁটলে দেখা যাবে তাদের কেউ জামায়াত-শিবির, কেউ ছাত্রদল, কেউ জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখনো পুরোনো সঙ্গীদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নানাভাবে যুক্ত রয়েছেন। অনেকে নানা অপরাধের কারণে মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য দলে ভিড়েছে। এসব ভিন্ন মত ও পথের মানুষ আবারও একত্রিত হয়ে ৭৫ পূর্ববর্তী সময়ের মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে সবকার তথা আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে- এমন আশক্সক্ষা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কাজেই আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধানী পদক্ষেপ নিতে হবে। অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে নির্মোহ দৃষ্টিতে নজরদারী করতে হবে। ৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতির কথা স্মরণ রেখেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলসহ সব সংগঠনকে সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাভোগীদের দূরভিসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক থেকেই নিজেদের কর্মকান্ড এগিয়ে নিতে হবে, যাতে একটুখানি ভুলের কারণে ১৫ আগস্টের মতো পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ কেউ না পায়। কারণ এতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গে পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী