অর্ধশত বছরের সম্পর্ক আরো শানিত হোক

4

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দুই দিনের জন্য রবিবার রাতে বাংলাদেশে আসেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সন্মেলন শেষে তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ঢাকায় আগমন করেন। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়ন দেশগুলো সরকারকে যখন বিভিন্ন বিষয়ে চাপ দিয়ে যাচ্ছে, তখন ইউরোপের বলিষ্ঠনেতৃত্বশীল দেশ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টর এর বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সময়ে ম্যাঁক্রোর এ সফর দু’দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস তাদের ফেসবুক পাতায় বলেছে প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলেছে, এই সফর দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাবে। উভয় দেশ অংশীদার হিসেবে পরস্পরকে পাশে চায় । ম্যাক্রোঁ সোমবার দিনব্যাপী ব্যস্ত সময় কাটিয়ে সন্ধ্যায় প্যারিসের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হন। এসময় শান্তি, সমৃদ্ধি ও জনগণের জন্য উভয় দেশের অংশীদারিত্বকে কৌশলগত স্তরে নেওয়ার জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনের সূচনা করেছিলেন, তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। তিনি বলেন, আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় সমগ্র বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
এ সময় ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। ‘আমরা উভয়েই আশা করি, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক-বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মূলত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আলোচনার পরে ‘বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতিতে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানুষের জন্য অংশীদার’ ঘোষণা করা হয়। ওই যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই পক্ষের সহযোগিতা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।
বলাবাহুল্য, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য কৌশলগত অংশীদার প্রয়োজন বাংলাদেশের এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে আগ্রহী ফ্রান্স। অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব-বলয় বাড়ানোর অংশ হিসেবে নতুন অংশীদার প্রয়োজন প্যারিসের, তাই অন্য আরও অনেক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বেছে নিয়েছে ফ্রান্স। এ কারণে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত খাতে সহযোগিতা বাড়াতে রাজি দুই দেশ।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সংক্ষিপ্ত এ সফরে বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা এবং এয়ারবাস কোম্পানি থেকে একটি স্যাটেলাইট ক্রয় সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছে। এছাড়া এয়ারবাস থেকে ১০টি বিমান ক্রয়ের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রæতিরও উল্লেখ আছে বিবৃতিতে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পঞ্চাশ বছরও পূর্তি হয়েছে চলতি বছর ফেব্রæয়ারিতে। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস জানিয়েছে ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্বিপাক্ষিক সফরে ঢাকায় এসেছেন। সে সময়ের ২১০ মিলিয়ন ইউরোর বাণিজ্য এখন ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে। বিভিন্ন ফরাসি কোম্পানি এখন বাংলাদেশে প্রকৌশল, জ্বালানি, এরোস্পেস ও পানি খাতে কাজ করছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। এখন শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে মি. ম্যাক্রোঁ ফিরতি সফরে ঢাকায় আসছেন। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সন্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ, জো বাইডেন নিজের মোবাইলে সেল্ফি তোলা, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ, শেখ হাসিনার প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিনয়াবনত শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও হৃদ্যতাপূর্ণ সাক্ষাৎসহ ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উঞ্চতা বৃদ্ধির এক মহামিশনের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ’র বাংলাদেশ সফর সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরকারের গ্রহণীয়তার প্রমাণ মিলে। আমরা মনে করি, আগামীদিনের বিশ্ব অর্থনীতির মূল প্রবাহে বাংলাদেশের সৃদৃঢ় অবস্থানের ইঙ্গিত রয়েছে এসব কার্যক্রমে। ধারাবাহিক নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাক-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।