তুষার দেব
দেশের অপরাধ জগতে একদা খুন-চাঁদাবাজিকে ছাপিয়ে আলোচনার শীর্ষস্থানটি দখল করে নিয়েছিল অস্ত্রের মুখে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। বিশেষ করে গত শতকের নব্বই দশকে অপরাধের এই ধরন সর্বত্র জনমনে ব্যাপক ভীতি ও আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সাম্প্রতিক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের পুরনো অপরাধ নতুন করে আবার ফিরতে শুরু করেছে। এ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল বাদে চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় সাম্প্রতিক সংঘটিত অপহরণের ঘটনাগুলো এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবেই দেখছেন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, অপহরণের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপহৃতরা উদ্ধারও হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় আনাও সম্ভব হয়েছে। আরও যারা জড়িত তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নুরে আলম মিনা পূর্বদেশকে বলেন, দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার অপরাধের ঘটনাগুলো ব্যতিক্রম। এর বাইরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি যে কয়টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, প্রত্যেকটি ঘটনার ভিকটিমকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ধার করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতার মুখে অপহরণকারী চক্র ভিকটিমকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পর্যটন অঞ্চল সাজেকে অপহৃত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে দ্রæততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার ও জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলার বোয়ালখালীতে অপহৃত ব্যবসায়ীকে উদ্ধারের পাশাপাশি জড়িত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হঠাৎ করে দুয়েকটি ঘটনা ঘটেছে মানে সেটা এলার্মিং পর্যায়ে যায়নি। যদিও আমরা এ ধরনের একটি অপরাধের ঘটনাও ঘটতে দিতে চাই না।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৭ আগস্ট রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়ার মুরগি খামার থেকে অপহরণ করা হয় কলেজছাত্র শিবলী সাদিককে। শিবলী কদলপুর স্কুল এন্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাবা মুহাম্মদ শফি পরিবহন ব্যবসায়ী। অপহরণের দু’দিন পর অপহরণকারীরা ওই কলেজছাত্রের মায়ের মুঠোফোনে কল করে ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। তখন ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এরপর গত ৩১ আগস্ট আবার কল করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। পরদিন গত ১ সেপ্টেম্বর শিবলীর বাবা দুই লাখ টাকা নিয়ে অপরহরণকারীদের কথামত পার্বত্য জেলা বান্দরবান সদরের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দুই জন লোকের হাতে তুলে দেন। তাখন ভিকটিমকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং বাড়িতে পৌঁছে যাবে বলে জানানো হয়। কিন্তু অপহরণের পর দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েও ছেলেকে এখনও ফিরে পাননি পরিবহন ব্যবসায়ী শফি।
পুলিশের দাবি, ভিকটিমকে উদ্ধারে জোর তৎপরতা চলছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে অপহরণের শিকার হওয়া বোয়ালখালীর বিকাশ এজেন্ট শহীদুল্লাহ টেলিকমের মালিক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বটে! বিকালে অপহরণের শিকার হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে তিনি রাতে অপহরণকারীদের কবল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ওইদিন রাতেই পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’জনকে গ্রেপ্তার করতেও সক্ষম হয়েছে।
তারা হলেন, কধুরখীল কৈবর্ত্যপাড়া এলাকার মাধব দাসের ছেলে চন্দন দাস (২৯) ও পোপাদিয়া ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহতরম বাড়ি এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক আবু তালেব (২৮)। গ্রেপ্তারের পর তারা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারদিন মুস্তাকিম তাসিনের আদালতে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে বোয়ালখালী পৌরসভার কধুরখীল গুইলদ্যাখালী এলাকা থেকে ব্যবসায়ী শহীদুল্লাহকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে নেয় সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্রের সদস্যরা। এরপর অটোরিকশায় থাকা ব্যক্তিরা তাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তার বিকাশ একাউন্ট থেকে অপহরণকারীদের তিনটি বিকাশ একাউন্ট নম্বরে এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা ট্রান্সফার করিয়ে নেয়। এরপর ওই ব্যবসায়ীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ এলাকায় তাকে ছেড়ে দেয়।
পুলিশের দাবি, ব্যবসায়িক যোগাযোগের কারণে পূর্ব কালুরঘাটের দোকানদার চন্দনই এ অপহরণ ও অর্থ আদায়ের পরিকল্পনার ছক কষেছেন। এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সিএমপি সূত্র জানায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া দশটার দিকে নিজ বাসার সামনে থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সী মো. আবদুল্লাহ নামে এক শিশু অপহরণের শিকার হয়। দুপুরে তার মা চান্দগাঁও থানায় গিয়ে এ বিষয়ে মামলা দায়ের করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাইয়ের পর অভিযানে নামে পুলিশ। নগরীর চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরা কুলাপাড়ায় রুহুল আমিনের বাড়ির সামনে থেকে অপহৃত হওয়ার দু’দিন পর তাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ৬ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় পুলিশ বক্সের পাশে শিশুটিকে পাওয়া যায়। পুলিশের তৎপরতার মুখে অপহরণের দুদিন পর অপহরণকারী চক্র তাকে সেখানে ফেলে রেখে যায়। ওইদিনই আবদুল্লাহকে বাবা-মায়ের কোলে তুলে দিয়েছে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। অপহরণের শিকার শিশু মো. আবদুল্লাহ নগরীর চান্দগাঁও থানার মোহরা কুলাপাড়ার বাসিন্দা দুবাই প্রবাসী মাহবুব আলমের সন্তান। পুলিশ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।