33

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

[গত সংখ্যার পর]
বঙ্গবন্ধু রাজনীতির মানুষ হলেও তার বক্তব্যে প্রায়শই রবীন্দ্রনাথের কবিতা থাকত। স্বপ্নের দেশের জাতীয় সংগীত চয়ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকেই। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে লাখো জনতার সামনে সেই রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ভিন্নভাবে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালির হে বঙ্গজননী! রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি, কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ ইতিহাসে ফিরে গেলে দেখি ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা সাহাব উদ্দিন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী এমন সকল রবীন্দ্রসংগীত ভবিষ্যতে পাকিস্তান বেতারে প্রচার করা হবে না। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ সকল প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন স্বেচ্ছার হয়ে উঠে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষক ছাত্র সংস্থা, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি ইসলামী ছাত্র সংঘ, পাকিস্তানে জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া, রূপায়ন সংস্কৃতি সংসদ প্রভৃতি সংস্থা রবীন্দ্র সংগীতকে রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাক্ষণের সঙ্গীতরূপে অভিহিত করে একে পাকিস্তানের সংস্কৃতির অঙ্গ বলে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ঐ সময় দৈনিক পাকিস্তানে পত্রিকায় ১১ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতিকে মারাত্মক আখ্যা দিয়ে ৪০ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তারা অভিমত দেন যে রবীন্দ্রনাথকে তারা বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই যে শুধু স্বীকার করেন না তা নয়, তারা মনে করেন যে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করলে পাকিস্তানি সংস্কৃতির মূল নীতিকেই বিরোধিতা করা হয়।
স্বাক্ষরকারীরা হলেন, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খা, বিচারপতি আবু মওদুদ, মজিবর রহমান খা, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কবি আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, কবি মইনুদ্দীন, অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দীন, আ.কা.ম. আদম উদ্দনি, তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, আ.ন.ম. বজলুর রশীদ, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, সানাউল্লাহ নূরী, আবদুস সাত্তার, আবুল কাসেম, মুফাখখারুল ইসলাম, শামসুল হক, ওসমান গণি, মফিজ উদ্দিন আহমদ, আনিসুল হক চৌধুরী, মোস্তাফা কামাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান, জহুরুল হক, ফারুক মাহমুদগ, মোহাম্মদ নাসির আলী, এ.কে.এম. নুরুল ইসলাম, কবি জাহানারা আরজু, বেগম হোসনে আরা, বেগম ফরহাদ চৌধুরী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও আকতারুল আলম। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসে ৬ দফা প্রস্তাব আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহিত হয়েছিল একথা আগেই বলা হয়েছে। তার আগে ফেব্রæয়ারি ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঐ দাবিনামা অনুমোদিত হয়েছিল। ফেব্রæয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শেখ মুজিব সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এই অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উপায়ান্তর খোঁজে না পেয়ে তাকে ১৯৬৬ সালের ৭/৮ মে তারিখে ভোররাতে গ্রেফতার করে। এরপর থেকে বিশ মাস দশদিন জেলে থাকার পর এবং জেলে থাকা অবস্থাতেই পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি মামলা দায়ের করে। এতে বলা হয় যে কয়েকবছর আগে থেকে শেখ মুজিব ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এ মামলাটির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত মামলাটির সরকারি নাম ছিল- ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য।’ ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন তারিখে ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যন্টনমেন্টের অভ্যন্তরে এ মামলার বিচার শুরু হয়। প্রচলিত আইনে অভিযুক্তদের বিচার করার বিধান ছিল না বলে আইন সংশোধন করে “ফৌজদারী আইন সংশোধনী বিশেষ ট্রাইবুনাল অর্ডিন্যান্স ১৯৬৮” নামক প্রেসিডেন্সের অর্ডিন্যন্স জারি করা হয়। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল। পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯ জুন ১৯৬৮ তারিখে ঢাকা ক্যন্টনমেন্টের সিগন্যাল ম্যাচ প্রাঙ্গনে বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার শুরু হবে। কিন্তু আগরতলা মামলার অভিযুক্ত আসামিদের বক্তব্য, মামলার কার্যবিবরণী, স্বাক্ষীদের জেরার বিবরণী যতই প্রকাশ হতে লাগলো ততই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধারনা করতে লাগলো এটি একটি সাজানো মামলা এবং শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী বানিয়ে ফাসি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছে। অভিযুক্তদের পক্ষে যেসকল আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছিলেন, তারা হলেন, আতাউর রহমান খান, ডক্টর আলীম আল রাজি, আবদুস সলামখা প্রমুখ। লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিরা অর্থ সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডের রাণীর আইন বিষয়ক উপদ্রেষ্টা টমাস উইলিয়াসবে অভিযুক্ত দের পক্ষে আইনি সহায়তার জন্য ঢাকায় পাঠান। আগরতলা মামলার পৃথকভাবে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এবং তারা পৃথমভাবে জনাববন্দি প্রদান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে তার লিখিত জবানবন্দি পাঠ করেন। এ জবানবন্দিটি ঐতিহাসিক বলে নিচে তা উদ্ধৃত করা হল :
আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের জবানবন্দি :
‘স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হইতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগনের আশা আকাক্সক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ গঠন করি। আওয়মীলীগ পূর্বেও ছিল এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পথানুসারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান।
১৯৫৪ সালে আমি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে এবং পরে জাতীয় বিধান সভায় সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ করি। অধিকন্তু আমি গণচীনে প্রেরিত বিধান পরিষদের এক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করি। জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠন করার জন্য আমাকে ইতোমধ্যে কয়েকবছর কারা নির্যাতন ভোগ করতে হইয়াছিল।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালে ১২ অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় বৎসরকাল বিনা বিচারে আটকে রাখে। আমাকে এইভাবে আটকে রাখাকালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে, কিন্তু ঐসকল অভিযোগ হইতে স্বসম্মানে অব্যহতি লাভ করি। ১৯৫৯ এর ডিসেম্বর কিংবা ১৯৬০ এর জানুয়ারিতে আমার উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিলাভকালে আমার উপর কিছু কিছু বিধি নিষেধ জারি করা হয়- যেমন : ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে। গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মতো আমার পিছু লাগিয়া থাকিত।
অতপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন আমাকেও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে কারাস্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামীলীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গদল হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীবতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরোধী দল এইসময় প্রেসিডেন্ট পদে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দান করে। আমরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। সরকারি কর্তৃপক্ষও পুনরায় আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়া আমাকে মিথ্যা বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে। (চলবে)
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, বঙ্গবন্ধু গবেষক ও প্রাবন্ধিক