নতুন বছরে অনেক প্রত্যাশা

35

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে ৪৯ বছরে পদার্পণ, তাই নতুন বছর আমাদের কাছে আশাপ্রদ। ২০২০ বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ এবং ২০২১ স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী। সেদিক থেকে ২০২০ আগমনী বার্তা আমাদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। নতুন বছরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সুবাতাস বয়ে যাবে, নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হবে, বেশকিছু সুসংবাদ বয়ে আনবে, তা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। গেল বছরের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আমাদের শুধরিয়ে নিতে চেষ্টা থাকবে, আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার ভিত্তিতে দেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে, দেশে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। সেজন্য সর্বপ্রথমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত রাখতে হবে। ঝিমিয়েপড়া রাজনৈতিক দলগুলো দমন-পীড়ন মুক্ত থাকবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল দলগুলো গণগন্ত্র চর্চার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সৃষ্টি করতে পারবে। দুর্নীতি আমাদের চারপাশে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে দূনীতির শিকড় উপরে ফেলতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে রাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে কঠোর আাইনের প্রয়োগ জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের বাস্তবায়ন ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবকাঠামোগত টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে দলীয় এবং রাজনীতিকে প্রাধান্য না দিয়ে অধিকতর যোগ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকার আরো বেশি আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথা মুহূর্তগুলো ম্লান হতে চলেছে, বর্তমান ছাত্রলীগের বেপরোয়া গতি এবং লাগামহীনতার কারণে। থামাতে হবে দেশের স্বার্থে। আবরার হত্যার মত ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই দিকে আমাদের নজর রাখা জরুরি। স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্ববহ। তবে দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল ও মতের সাথে সুন্দর বোঝাপড়া এবং ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা আমাদের দায়িত্বে বর্তায়।
দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে কৃষকের অবদান অনস্বীকা্য‍‍‍। কৃষিতে সফলতা যেমন সত্য, তেমনিভাবে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকারও সত্য। ২০১৯ জুড়েই প্রবাসীদের রেমিটেন্স খাত উজ্জ্বল ও ইতিবাচক। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত করে যাচ্ছে প্রবাসীরা। বিমান বন্দরে প্রবাসীদের হয়রানী না করার ব্যাপারে সরকার প্রধানের হুশিয়ারী অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। পোশাক শিল্পে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। তবে ২০১৯ সালে আশানুরূপ রপ্তানি হয়নি। শ্রমিকদের নুন্যতম (ঘোষিত) মজুরির নিশ্চয়তা থাকা বাঞ্চনীয়। শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব মোচনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চলের যথাযথ উন্নয়ন এবং দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ এক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে জনগণের জীবন মান উন্নয়ন সার্বিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
২০১৯ জুড়ে আমাদের প্রাপ্তি কম নয়। অপ্রাপ্তি ও অস্বীকার করা যাবে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নে দেশকে বহির্র্বিশ্বে সমাদৃত করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্নফুলি টানেল এর মত বড় বড় প্রকল্পগুলো বর্তমানে দৃশ্যমান। ঢাকা হতে চট্টগ্রাম ডাবল রেল লাইন এবং কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলমান। দেশে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। কৃষিতে বৈপ্লবিক সাফল্য এসেছে, খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ , বৈদ্যুতিক খাতে অর্জন উল্লেখযোগ্য, মানুষের দৈনন্দিন আয় বেড়েছে, ২০২০ সালে দেশের মাথাপিছু গড় আয় ২০০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, নারী শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে নিঃসন্দেহে। নানা সামাজিক সূচকে অগ্রগতি বিশ্বে প্রশংসিত। আমাদের অর্জন এবং উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে চাই।
শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, শিক্ষাখাতে সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয় শুধু প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ওপর নির্ভর করা যাবে যাবে না। তবে শিক্ষার গণগত মান বৃদ্ধি হচ্ছে না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন আমাদেরকে ব্যথিত করে। ছাত্ররা বেশিরভাগ সময় অপরাজনীতি চর্চাতে ব্যস্ত, দখলত্ববাদ বর্তমান ছাত্ররাজনীতির মূলমন্ত্র। পাশাপাশি পাবলিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের প্রকাশ্যে দলবাজি সত্যিই অবাক বিষয়। সে কারণে ছাত্ররা শিক্ষকদের রোষানলে। বস্তুতঃ বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে, বর্তমান ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে বড় ফারাক। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য।
৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজমান। জাতিয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আকার-প্রকৃতি ভিন্ন। দল বা জোট মনোনয়ন দিলেও প্রার্থীর যোগ্যতা হবে নির্বাচনের মাপকাঠি। যেহেতু নির্বাচিত হওয়ার পরে দলীয় মেয়র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন না, নগর পিতা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া আগে থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থার অভাব। তবে দুই-একটি মেয়র নির্বাচন নিরপেক্ষতার দাবী রাখে। সেদিক থেকে ভোটারদের প্রত্যাশা বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি এবার সাড়া জাগিয়েছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। জন কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য নির্বাচনকে স্বচ্ছতার মাধ্যমে কার্যকরী করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে বর্তায় এবং চ্যালেঞ্জও বটে। ইভিএম এর সফল ব্যবহার ভোট কারচুপি রোধে হবে হাতিয়ার। ঢাকাবাসী একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অপেক্ষায় অপেক্ষমান।
বিএনপি একটি বড় দল। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বর্তমানে অনেকটা নিষ্ক্রিয়, ইচ্ছা থাকলেও রাজনীতি চর্চায় যাবতীয় কর্মকান্ড সঠিকভাবে করতে পারেনি। মিটিং-মিছিলতো দূরের কথা, মানববন্ধনও করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তাদের দূর্বলতার পাশাপাশি প্রতিহিংসার বিষয়টি ওঠে এসেছে। রাজনীতির মাঠে যদি প্রতিযোগিতাই না থাকে, তাহলে কেউ বিজয়ী একথা প্রকাশ করাই বাতুলতা। মুজিববর্ষ হিসেবে ২০২০ সাল হবে অর্থবহ। সেদিক থেকে সব দলের কর্মকান্ড সাবলীল হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল রাজনীতির মাধ্যমে এবং দেশের স্বাধীনতা রাজনীতির মাধ্যমে। কাজেই দেশের অগ্রগতি এবং প্রবৃদ্ধির স্বার্থে রাজনীতির চাকা সচল রাখা জরুরি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠমোতে সরকারকে আরো সংবেদনশীল হওয়ার ্ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবের শতবর্ষ বাঙালি জাতির অহংকার। তাই এই দিনে দলমত হিসেবে আমাদের মধ্যে বিভক্তি কাম্য নয়। মুজিববর্ষের নানাবিধ কর্মসূচিতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দেশ এবং জাতির জন্য এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

লেখক : কলামস্টি